আমীর মুয়াবিয়া (রা.) কি আসলেই 'খলিফায়ে রাশেদ' ছিলেন?
-আবছার তৈয়বী
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে একটি 'ফোবিয়া' চালু হয়েছে বেশ দীর্ঘকাল ধরে। সেই ফোবিয়ায় কমবেশি সবাই আক্রান্ত। সেই ফোবিয়ার নাম- 'মুয়াবিয়া প্রীতি এবং আহলে বায়ত ভীতি'। এই ফোবিয়ার অন্যতম দু'টি 'সিনড্রম' হলো- ১. পারতঃপক্ষে আহলে বায়তের প্রসঙ্গই উল্লেখ না করা। আবার এর দু'টি সিম্বল আছে। ক. উল্লেখ করলেও গুরুত্বহীনভাবে দায়সারা গোছের উল্লেখ করা। খ. কেউ আহলে বায়তের সম্মানহানি করলেও চুপ থাকা এবং দেখেও না দেখার ভান করা।
সেই ফোবিয়ার ২য় সিনড্রমটি হলো- ২. আহলে বায়তের দুশমনদের পক্ষাবলম্বন করা। আবার এরও দু'টি সিম্বল আছে। ক. সেই পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে মুয়াবিয়া (রা.) যা নন, তাঁকে তা বলা। খ. বলতে গিয়ে পূতঃপবিত্র আহলে বায়তে রাসূলের (দরুদ) সম্মানহানি করা এবং তাঁদের ওপর অপবাদ চাপানো।
যেহেতু প্রায় পুরো সমাজটাই 'ফোবিয়া আক্রান্ত', সেহেতু এ বিষয়ে কোনটি সত্য, আর কোনটি মিথ্যা- তা তারা কেউই যাচাই করার সক্ষমতা রাখে না। অনুভব করতে পারে না- কোন কথাটি বলা উচিত, আর কোন কথাটি বলা অনুচিত। আপনি যখন কোরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস এবং আকাবির উলামায়ে আহলে সুন্নাতের মতামতের ভিত্তিতে সত্য বলতে যাবেন, তখনই শত মুুখে আপনাকে বলবে- 'চুপ, চুপ! একদম চুপ!' সুযোগ পেলে দীন সম্পর্কে টোটালি অজ্ঞ ছোকরা-ছুকড়ি পর্যন্ত আপনার দিকে 'ফতোয়াস্ত্র' তাক করে বত্রিশ দন্ত কেলিয়ে লাফাতে থাকবে এবং একের পর এক ফতোয়া মেরে নিজেরা নিজেরা হাসাহাসি করবে। আর আপনাকে চুপ থাকতে বলে তারা দুশমনে আহলে বায়তের (আ. ও রা.) ঝুটা প্রশংসায় মেতে উঠবে!
সেই ঝুটা প্রশংসার নমুনা ও ভয়ঙ্কর প্রকাশ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। শুধু প্রকাশই হয়নি, ইতোমধ্যে তা সুন্নী জনমনে পেরেক মেরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তার একটি হলো- আমীর মুয়াবিয়াকে 'খলিফা' তাও আবার 'রাশেদ' প্রমাণ করা। অন্যটি হলো- তাঁকে আহলে বায়তের 'মুহিব্ব' (প্রেমিক) প্রমাণ করা। আর এ দু'টি মিথ্যা দাবি প্রমাণ করতে গিয়ে বর্তমান জামানায় আহলে সুন্নাতের কিছু নামকরা উলামা এমন সব কথা বলছেন, যা পুরোপুরিই সত্যের বিপরীত এবং আহলে সুন্নাতে সকল আকাবেরীন উলামাদের মতামতের খেলাফ। এমনকি এটি করতে গিয়ে তাঁরা পূতঃপবিত্র আহলে বায়তের (আ. ও রা.) ওপর মিথ্যা অপবাদ দিতেও দ্বিধা করছেন না! (নাঊজুবিল্লাহ) উল্লেখ্য, তাঁদের দু'টি দাবিই যে সর্বৈব মিথ্যা- তা আমি প্রিয় রাসূলের (দরুদ) হাদীস দিয়েই প্রমাণ করবো। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিঞ্চিত আলোচনা করতে চাই।
আসলেই কি আমীর মুয়াবিয়া (রা.) 'খলিফায়ে রাশেদ' ছিলেন? অথচ ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন যে, তিনি ছিলেন উমাইয়া রাজা, খলিফা নন। রাশেদ হওয়া তো দূর কি বাত। চলুন- আমরা এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস পর্যালোচনা করি।
[০১]
حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ دَاوُدَ الطَّيَالِسِيُّ: حَدَّثَنِي دَاوُدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ الْوَاسِطِيُّ: حَدَّثَنِي حَبِيبُ بْنُ سَالِمٍ عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ: كُنَّا قُعُودًا فِي الْمَسْجِدِ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - وَكَانَ بَشِيرٌ رَجُلًا يَكُفُّ حَدِيثَهُ، فَجَاءَ أَبُو ثَعْلَبَةَ الْخُشَنِيُّ فَقَالَ: يَا بَشِيرُ بْنَ سَعْدٍ أَتَحْفَظُ حَدِيثَ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - فِي الْأُمَرَاءِ؟ فَقَالَ: حُذَيْفَةُ أَنَا أَحْفَظُ خُطْبَتَهُ فَجَلَسَ أَبُو ثَعْلَبَةَ فَقَالَ حُذَيْفَةُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: « تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا عَاضًّا فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا جَبْرِيَّةً فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةً عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ». ثُمَّ سَكَتَ قَالَ حَبِيبٌ: فَلَمَّا قَامَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ وَكَانَ يَزِيدُ بْنُ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ فِي صَحَابَتِهِ فَكَتَبْتُ إِلَيْهِ بِهَذَا الْحَدِيثِ أُذَكِّرُهُ إِيَّاهُ فَقُلْتُ لَهُ: إِنِّي أَرْجُو أَنْ يَكُونَ أَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ يَعْنِي عُمَرَ بَعْدَ الْمُلْكِ الْعَضِّ وَالْجَبْرِيَّةِ فَأُدْخِلَ كِتَابِي عَلَى عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فَسُرَّ بِهِ وَأَعْجَبَهُ.
অর্থাৎ: সুলাইমান ইবনে দাউদ আততায়ালিসী দাউদ ইবনে ইব্রাহীম আল ওয়াসেতী হাবীব ইবনে সালিম নু'মান ইবনে বশীর থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মসজিদে বসা ছিলাম। আর বশীর রাসলের (দরুদ) হাদীস সংরক্ষণ করতেন। অতঃপর আবূ সা'লাবা আল খুশানী আসলেন। তারপর বললেন- হে বশীর ইবনে সা'দ তুমি কি নেতৃত্বের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন হাদীস মুখস্থ করেছো? অতঃপর হোজায়ফা বললেন, আমি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খোতবা মুখস্থ করেছি। এরপর আবূ সা'লাবা বসে পড়লেন। অতঃপর হোজায়ফা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেছেন- "আল্লাহ যতোদিন চাইবেন, তোমাদের মাঝে নবুওয়তের ধারা অব্যাহত রাখবেন। অতঃপর তিনি যখন তা উঠিয়ে নিতে চাইবেন, উঠিয়ে নেবেন। তারপর আল্লাহ যতোদিন চাইবেন তোমাদের মাঝে নবুওয়তের আলোকে খিলাফত অব্যাহত রাখবেন। তারপর আল্লাহ যখন তা উঠিয়ে নিতে চাইবেন, উঠিয়ে নেবেন। তারপর তোমরা স্বৈর রাজত্বের অধীন হয়ে যাবে। আল্লাহ যতোদিন চাইবেন, ততোদিন তা অব্যাহত থাকবে। তারপর তিনি যখন তা উঠিয়ে নিতে চাইবেন, উঠিয়ে নিবেন। অতঃপর তোমাদের মাঝে জুলুমের রাজত্ব বিরাজ করবে। তারপর আল্লাহ যতোদিন চাইবেন, তা অব্যাহত থাকবে। অতঃপর তিনি যখন তা উঠিয়ে নিতে চাইবেন, উঠিয়ে নেবেন। তারপর (আবার তোমাদের মাঝে নবুওয়তের আলোকে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। অতঃপর তিনি চুপ করে থাকলেন। অতঃপর আমার চিঠি হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয এর কাছে পৌঁছানো হয়।"
হাবীব বললেন, উমর ইবনে আবদুল আযীয (রা.) যখন শাসনভার নিলেন, ইয়াযিদ ইবনে নু'মান বিন বশীর তার সভাসদ হলেন। আমি তাঁর কাছে এই হাদীসটি লিখে পাঠালাম। এবং তাঁকে এ ব্যাপারে স্মরণ করিয়ে দিলাম। অতঃপর তাঁকে বললাম- আমি আশা করছি যে, স্বৈরশাসন এবং জুলুমবাজ রাজত্বের পরে হাদীস সম্বলিত এই চিঠি যেন আমীরুল মুমিনীন মানে উমরের নিকট পৌঁছে। অতঃপর এটা পড়ে তিনি যুগপৎভাবে আনন্দিত হন এবং আশ্চর্যবোধ করেন।"
[মুসনাদে আহমদ: ১৪/১৬৩, হাদীস নম্বর: ১৮৩১৯, দারুল হাদীস, প্রথম সংস্করণ:১৪১৬ হি.]
হাদীসের মান: সহীহ্।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আহলে সুন্নাতের সর্বজন মান্য প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) বলেন, "এর অর্থ হলো- অতঃপর নবুওয়ত খিলাফতে বা হুকুমতে বা ইমারতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। মানে আল্লাহ যতোদিন চাইবেন, 'খিলাফত' বাস্তবিক অর্থেই বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে নবুওয়তের পথে/আলোকে পরিচালিত হবে। আর হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী খিলাফতকাল ৩০ বছর। তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে- কামড়া-কামড়ির স্বৈর রাজত্ব। রাজত্বের অধিকারীরা পরস্পর পরস্পরের সাথে কামড়া-কামড়ি করবে, যেভাবে 'কুকুর কামড়া-কামড়ি করে থাকে।' সেভাবে শাসকরাও রাজত্ব নিয়ে কামড়া-কামড়ি করবে। আল্লাহ যতদিন চাইবেন, এভাবেই চলতে থাকবে। তারপর আল্লাহ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেবেন। তারপর শাসন ক্ষমতা জোর-জুলুমের মুল্লুকে পরিণত হবে। মানে রাজত্বে ব্যাপকহারে জোর-জুলুম হবে এবং বিশালকার রাজত্ব হবে। আল্লাহ যতোদিন চাইবেন, তা বহাল রাখবেন তারপর এই জোর-জুলুমের রাজত্বও আল্লাহ উঠিয়ে নেবেন। তারপর এই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে আবার প্রকৃত খিলাফতে ফিরে আসবে। অর্থাৎ নবুওয়তের আলোকে পরিপূর্ণ ন্যায়-নীতির সাথে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। এই খিলাফত মানে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও মাহদী রাহিমাহুল্লাহ'র সময়কাল বুঝানো হয়েছে।" (মিরকাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ: ১৫/৩৩০)
এ সম্পর্কে ইমাম মানাভী (রহ.) বলেন, "নবুওতের খিলাফতকাল পূর্ণ হওয়ার পরই মুলুকিয়ত আসবে। খিলাফতকে এজন্যই খিলাফত নামকরণ করা হয়েছে যে, খিলাফত সুন্নাহর আলোকেই পরিচালিত হয়। এর বিপরীতে রাজাই হয়, খলিফা নয়।"
তারিখে তাবারীতে আছে- "খোলাফায়ে রাশেদীন হলো, মহান চার নেতৃত্ব। তাঁরা হলেন- আবূ বকর, উমর, উসমান ও আলী (রাদ্বিআল্লাহু আনহুম)। যাঁরা উম্মতের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (দরুদ)'র স্থলাভিষিক্ত হন। আর তাঁদের খেলাফতকাল হলো- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের ১১ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল তাঁর মহান বন্ধুর কাছে গমন থেকে শুরু করে আলী ইবনে আবি তালিবের (আ. ও রা.) শাহাদাতকাল ১৭ রমজান ৪০ হিজরী পর্যন্ত ২৯ বছর ৬ মাস ৫ দিন হয়। যদি এর সাথে হাসান ইবনে আলীর খেলাফতকাল যুক্ত করা হয়, তবে পরিপূর্ণভাবে ৩০ বছর হয়। আর তাঁদেরকে 'রাশেদীন' গুণের সাথে নির্দিষ্ট করে এ জন্যই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁরা স্বত্বাতগভাবেই এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, উম্মতকে তাদের দীন ও আকীদায় সঠিক পথে পরিচালনাকারী, তত্ত্বাবধানকারী এবং উম্মতকে রাসূলুল্লাহ আদর্শালোকে দাওয়াত, জিহাদ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করার ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষনকারী।"
[এ সম্পর্কিত আরো বর্ণনা দেখুন-
বায়হাকী- দালায়েলুন নুবুওওয়াহ: ৬/৪৯১, ইবনুল জওযী- জামেউল মাসানীদ:২/৩০৯-৩১০, তাবরানী- আল মুজামুল কবীর: ১১/৮৮/ ১১১৩, ইবনে হিব্বান- ৮/২৬, ইবনে কাসীর- জামেউল মাসানীদ ওয়াস সুনান: ৩/৩৫২-৩৫৩, বুগয়াতুর রায়িদ ফি তাহকীকি মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ৫/৩৪১-৩৪২, আলবানী- আল সিলসিলাতুস সাহীহা: ১/৩৪-৩৫]
[০২]
খিলাফতের মেয়াদকাল:
حدثنا سوار بن عبد الله ثنا عبد الوارث بن سعيد عن سعيد بن جمهان عن سفينة قال « قال رسول الله ﷺ " خلافة النبوة ثلاثون سنة ثم يؤتي الله الملك أو ملكه من يشاء " »
قال سعيد قال لي سفينة أمسك عليك أبا بكر سنتين وعمر عشرا وعثمان اثنتي عشرة وعلي كذا قال سعيد قلت لسفينة إن هؤلاء يزعمون أن عليا عليه السلام لم يكن بخليفة قال كذبت أستاه بني الزرقاء يعني مروان.
অর্থাৎ: সওয়ার বিন আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছন, তিনি আবদুল ওয়ারিস বিন সাঈদ থেকে, তিনি সাঈদ বিন জুমহান থেকে তিনি প্রিয় রাসূলের খাদেম হযরত সফীনা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেছেন, " নবুওওয়তের ভিত্তিতে খিলাফতকাল ৩০ বছর স্থায়ী হবে। তারপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজত্ব বা তাঁর রাজত্ব দান করবেন।
বর্ণনাকারী সাঈদ বলেন, হযরত সাফীনা (রা.) আমাকে বললেন, গুনতে থাকো- হযরত আবু বকরের (রা) ২ বছর, হযরত উমরের (রা.) ১০ বছর, হযরত উসমানের (রা.) ১২ বছর আর হযরত আলীর (আ. ও রা.) বাকিটা। সাঈদ বললেন, আমি হযরত সফীনা (রা.) কে বললাম- তারা তো ধারণা করে যে, "আলী #আলাইহিস_সালাম খলিফা নন!" তিনি বললেন- "বনু যুরাকা (নীল চক্ষুওয়ালারা) জঘন্য মিথ্যাচার করছে।" অর্থাৎ মারওয়ান। [আবূ দাঊদ, হাদীস নম্বর: ৪৬৪৬, হযরত সফীনা (রা.) থেকে অন্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসেও (হাদীস নম্বর: ৪৬৪৭) নবুওওয়তের আলোকে খেলাফতকাল ৩০ বছর বলে বর্ণিত আছে।
[০৩]
আবূ দাউদ ছাড়াও 'খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওওয়াহ' এর প্রমাণ স্বরূপ এ হাদীসটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রামাণ্য হাদীসের কিতাব তিরমিজি (হাদীস নম্বর: ২২২৬), মুসনাদে আহমদ (হাদীস নম্বর: ২১৯১৯) সহীহ ইবনে হিব্বান (হাদীস নম্বর: ৬৯৪৩) প্রিয়নবী (দরুদ) এর খাদেম হযরত সাফীনা (রা.) থেকে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে এভাবে বর্ণিত আছে:
رواه سفينة مولى رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: الخلافة ثلاثون عاماً ثم يكون بعد ذلك الملك، قال سفينة: أمسك؛ خلافة أبي بكر سنتين ، وخلافة عمر عشر سنين، وخلافة عثمان اثنتي عشرة سنة وخلافة علي ست سنين"، وقال الترمذي : هذا حديث حسن.
অর্থাৎ: প্রিয় রাসূলের খাদেম হযরত সফীনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেছেন, "খিলাফতকাল ৩০ বছর। এরপর তা মুলুকিয়তে রূপ নেবে।" হযরত সাফীনা (রা.) বললেন, হিসাব ধরো- হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতকাল ২ বছর, হযরত উমরের (রা.) খিলাফত কাল ১০ বছর, হযরত উসমানের (রা.) খিলাফতকাল ১২ বছর, আর হযরত আলীর (আ. ও রা.) খিলাফত কাল ৬ বছর। ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন- এ হাদীসের মান 'হাসান' পর্যায়ের।
ইমাম বগভী (রহ.) সরহুস সুন্নাতে হামিদ যানজুভিয়্যা'র বরাতে বর্ণনা করেছেন- বিভিন্ন বর্ণনার আলোকে এই (৩০ বছরের) সময়কালকে নবুওওয়তের আলোকে খিলাফত বলার কারণ হলো- "খলিফাগণ তাঁদের কর্মনীতি দ্বারা এই নামকরণকে সত্যে পরিণত করেছেন, তাঁরা তাঁদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরেছেন এবং শরীয়তের হুকুম-আহকাম যথাযথভাবে বলবৎ করেছেন।"
হযরত সফীনা (রা.) খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনকালের যে হিসাব দিয়েছেন, তা হলো মোটামুটি হিসাব। ইমাম জালাল উদ্দীন সুযূতী (রহ.) বলেন, "রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে ৪ জন খলিফা এবং হাসান (আ ও রা.) শাসনকাল ছাড়া ৩০ বছর পূর্ণ হয় না।" ( তুহফাতুল আহওয়াযী)।
ইবনে কাসীর (রহ) তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে উল্লেখ করেছেন,
إنما كملت الثلاثون بخلافة الحسن بن علي، فإنه نزل عن الخلافة لمعاوية في ربيع الأول من سنة إحدى وأربعين، وذلك كمال ثلاثين سنة من موت رسول الله صلى الله عليه وسلم، فإنه توفي في ربيع الأول سنة إحدى عشرة من الهجرة، وهذا من دلائل النبوة،
অর্থাৎ " নিশ্চয়ই হাসান ইবনে আলীর (আ. ও রা.) খিলাফতকালের মাধ্যমেই ৩০ বছর পূর্ণ হয়। কেননা তিনি মুয়াবিয়ার পক্ষে খিলাফত ত্যাগ করেন ৪১ হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসে। আর এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত থেকে ৩০ বছর পূর্ণ হয়। কেননা, তিনি (দরুদ) ১১ হিজরী সালের রবিউল আওয়াল মাসেই ওফাত পান। আর এটা নবুওয়তের অন্যতম দলিল।"
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকাবেরীন সকল ইমাম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকিহ, মুতাকাল্লেমীন, ইতিহাসবিদ এবং উলামাগণ এই কথার ওপর একমত যে, 'খিলাফা আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ'র মেয়াদকাল ছিল ৩০ বছর। একদিন বেশিও না এবং একদিন কমও না। যা প্রিয় রাসূল (দরুদ)'র নবুওয়তি যুবানে ঘোষিত হয়েছে। আর একে আহলে সুন্নাতের উলামারা 'দালায়েলুন নুবুওওয়াহ' বা প্রিয়নবী (দরুদ) এর 'নবুওয়তের দলিল' হিসেবে সাব্যস্থ করেছেন।যারা এই মেয়াদকালে মুসলিম জাহানের খিলাফতের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদেরকে একবাক্যে 'খোলাফায়ে রাশেদীন' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই মহান খলিফায়ে রাশেদগণ হলেন, যথাক্রমে ১. সায়্যিদুনা আবূ বকর সিদ্দীকে আকবর (রা.), ২. সায়্যিদুনা উমর ফারুকে আজম (রা.), ৩. সায়্যিদুনা উসমান জুননুরাইন (রা.), ৪. সায়্যিদুনা মওলা আলী মরতুজা (আ. ও রা.) এবং ৫. সায়্যিদুনা মওলা হাসান মুজতাবা ইবনে আলী (আ. ও রা.)। এই ৫ জনের বাইরে কোন 'খলিফায়ে রাশেদ' ছিল না। পরবর্তী "খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওওয়াহ" আলোকে খলীফায়ে রাশেদ হবেন হযরত ঈসা (আ.) ও ইমাম মাহদী (আ.)।
উপরোক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে এবং মুয়াবিয়া (রা.)'র শাসনকাল পর্যালোচনা করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুয়াবিয়া (রা.) আর যাই হোন, কোন অবস্থাতেই 'খলিফায়ে রাশেদ' ছিলেন না। এমতাবস্থায় তাঁকে 'খলিফায়ে রাশেদ' বলা মানে প্রিয় রাসূল (দরুদ) অসংখ্য হাদীসকে সরাসরি অস্বীকার করার নামান্তর এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকাবির উলামা ও সালফে সালেহীনের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ। কুখ্যাত খারেজি- নাসেবী এমনকি খোদ উমাইয়া শাসক ও তাদের অনুগ্রহভাজনরাও কখনোই এমনটি দাবি করেনি। সেই সাথে এটা মহান খোলাফায়ে রাশেদীন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)'র 'তওহীন', পূতঃপবিত্র আহলে বায়তের (আ. ও রা.)'র তওহীন তথা সম্মানহানি করা। যা সর্বৈব মিথ্যাচার, অন্যায়, অন্যায্য এবং অযৌক্তিক বাড়াবাড়ি। আমি মনে করি- এটি একটি 'মারাত্মক ফিতনা'। যার ফলে উমাইয়া রাজার শান তো বাড়বেই না; বরং তাঁর সমালোচনার দ্বার আরো উম্মুক্ত, তীর্যক ও বেগবান করবে। আল্লাহ এই ফিতনা থেকে সকল মুসলমানকে হেফাজত করুন। আমীন! বিহুরমাতি রাহমাতুল্লিল আলামীন, সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাহবিহী ওয়াসাল্লামা। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ....
[বি.দ্র: ফিতনা রোধে এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় লেখাটি বেশি বেশি শেয়ার করুন। কপি করে অবিকৃতভাবে নিজেদের টাইমলাইনসহ সর্বত্র পোস্ট করুন।]
তারিখ: ০৪ অক্টোবর, ২০১৯ খৃ.
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।
Comments
Post a Comment