কেন আমি এই কোয়ান্টাম মেথড ত্যাগ করলাম
লেখক:শেখ আহসান উদ্দিন
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার।দরূদ ও সালাম মহানবী(সাঃ) ও তার পরিবারের প্রতি।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন,"নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহ তায়ালার নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন/ধর্ম" (৩:১৯)।মহানবী(সাঃ) বলেন "দুটি জিনিস আকড়ে ধরলে কেউ পথভ্রষ্ট হবেনা। সেই দুটি জিনিস হলো আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহ।"
কোয়ান্টাম মেথড/কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আমাদের বাংলাদেশের একটি অন্যতম সংস্থা।তবে এটি একটি বিতর্কিত দল/সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানের নাম আমি ২০১৫ বা ২০১৬সালে যখন আমি স্কুলে পড়তাম তখন শুনেছিলাম।হাসপাতাল,দোকান,ফার্মেসী সহ অনেক জায়গায় "রেগে গেলেন তো হেরে হেলেন" এমন সুন্দর ও চটকদার কথার স্টিকার দেখলাম,সেগুলা কোয়ান্টাম মেথডের স্টিকার। দেশের প্রতি জেলায় জেলায় এদের কার্যক্রম রয়েছে।বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রবাসে অন্যান্য দেশেও এদের শাখা রয়েছে।
এই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আগে নাম ছিল যোগ ফাউন্ডেশন। এই কোয়ান্টাম মেথড তারা মূলত মেডিটেশন/ধ্যান কে প্রমোট করে। এরা একটি এনজিও সংস্থাও বটে। এই কোয়ান্টাম মেথড এটা ১৯৯৩ সালে শহীদ বোখারি মহাজাতক ওরফে শহীদুল শিকদার নামে এক জ্যোতিষী টাইপের লোক প্রতিষ্ঠা করেছিল।আমি জানতে পেরেছিলাম যে এই লোক তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম পত্রিকা "দৈনিক ইত্তেফাক"সহ কয়েকটা পত্রিকায় ধ্যান,মেডিটেশন,যোগব্যায়াম নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখত।তবে বাংলাদেশের অনেক আলেম উলামায়ে কেরামরা অভিযোগ করেন যে, এই শহীদ বোখারি মহাজাতক মেডিটশনের আড়ালে ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচার করছে। এই কোয়ান্টাম মেথড থেকে "কোয়ান্টাম কণিকা", "অটোসাজেশন"," আল কুরআন বাংলা মর্মবাণী","হাজারো প্রশ্নের জবাব","মনছবি উচ্ছাস"সহ তাদের অনেক বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে এবং তারা "অটোসাজেশন কণিকা"," কুরআন কণিকা(১-৪)","হে মানুষ শোনো(বিদায় হজের ভাষণ","হাদিস কণিকা","রমাদান কণিকা"সহ অনেক কণিকা/বুকলেট তারা প্রকাশ করেছে। তারা বিধর্মীদের জন্য বেদ-গীতা,বাইবেল ও ত্রিপিটক ধম্মপদ কণিকা প্রকাশ করেছিল। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় তাদের প্রকাশনা রয়েছে। কিন্তু তাদের অন্যতম কাজ হলো মেডিটেশন।
তাদের মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী,মেডিটেশন ও প্রোগ্রাম রয়েছে।কোয়ান্টাম মেথডে প্রতিবছর তিন/চার দিন ১০ঘন্টা মেডিটেশন কোর্স করা হয়।সারাদেশে তাদের কার্যক্রম লক্ষনীয়। যারা কোয়ান্টাম মেথডের প্রোগ্রামে গিয়েছেন সেসব ব্যক্তিবর্গের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নাই।বরং বিরোধটা কোয়ান্টামের কতিপয় বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের সাথে।ঢাকার শান্তিনগর অথবা কাকরাইলে তাদের হেডকোয়ার্টার। প্রতি শুক্রবার তাদের 'সাদাকায়ন'(মেডিটেশন ও বক্তব্য)কর্মসূচী হয়।তাদের মাটির ব্যাংক ও যাকাত ফান্ড আছে ।ইন্টারনেটে তাদের মতবাদের প্রচার লক্ষনীয়।তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং এন্ড্রয়েড মোবাইলে প্লে-স্টোরে তাদের অ্যাপস রয়েছে।
আমি প্রথম কোয়ান্টামীদের প্রোগ্রামে যাওয়া শুরু করি ২০১৭সালের মে মাসে। তাদের 'সাদাকায়ন' প্রোগ্রামে কোয়ান্টামের পুরান ঢাকার লক্ষীবাজার শাখায় যেতাম।সেখানে দেখি একপাশে পুরুষ অপর পাশে মহিলাদের বসার জায়গা।সেখানে পুরুষ মহিলা একত্রে প্রোগ্রাম করে।রমযান মাসে তাদের প্রকাশিত আল কুরআন বাংলা মর্মবাণী পড়তাম। তারা বলে এটা অনুবাদ নয় বরং তা ভাবানুবাদ বা মর্মবাণী৷ এদের প্রকাশিত আল কুরআন বাংলা মর্মবাণীর ব্যাপারেও অনেক আপত্তিকর অভিযোগ শোনা গিয়েছিল। বলা চলে,২০১৭এর এপ্রিল থেকে ২০১৮এর আগস্ট এই দেড় বছর কোয়ান্টামিদের মেডিটেশন করতাম ও তাদের প্রোগ্রামের যেতাম৷ কিন্তু আস্তে আস্তে গত ২০১৯ এ SSC পরীক্ষার পরবর্তী ছুটিকালীন সময়ে তাদের প্রোগ্রামে যাওয়া, মেডিটেশন করা এবং তাদের বই পুস্তক বুলেটিন পড়া বন্ধ করলাম ধর্মীয় ও পারিবারিক দিক বিবেচনা করে। তাদের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে এলাম।কারণ তাদের মতাদর্শ মূলত ফিতনা হয়ে গেছে৷ তারা বাহ্যিকভাবে একরকম কিন্তু আড়ালে অন্যকিছু। তারা বাহ্যিকভাবে মেডিটেশন ও মানবসেবার কাজ করলেও তারা মূলত সম্রাট আকবরের ভ্রান্ত দ্বীনে ইলাহির অনুসরণ,ইলুমিনাতি ও অন্যান্য অনেক ভ্রান্ত মতবাদ প্রমোট করছে। তাদের আল কুরআন বাংলা মর্মবাণী এটিতে অনেক ভুল ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য লেখা আছে।যদিও এর প্রকাশক দাবী করেন "তিনি ০৮টি অনুবাদ ও তাফসীরের আলোকে করেছেন৷ সেগুলো হলো,মর্মাডিউক পিকথলি,আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী,মুহাম্মদ আসাদ,মাওঃ আশরাফ আলী থানভী,সাইয়েদ কুতুব শহীদ,মুফতি মুহাম্মদ শফী,আল্লামা শাব্বীর উসমানি ও মাওঃ আব্দুর রহিমের অনুবাদ ও তাফসীরের সহায়তা নিয়েছেন। " এখানে এই আটজনের অনুবাদ ও তাফসীরের কারও একে অপরের মিল নাই৷যে কারণে এই শহিদ বোখারী মহাজাতকের কোয়ান্টামিদের ফাঁদ খপ্পর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছি।বিদআতী,কাদিয়ানী, খ্রিস্টান মিশনারী,হেজবুর তাওহিদের মতো এই কোয়ান্টাম মেথড ভ্রান্ত দল।
এখানে কোয়ান্টামিদের শুধু ০৬ টি ভ্রান্ত মতাদর্শ ও তার খন্ডন দেওয়া হলো :
১. এটি তাওহীদ বিশ্বাসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং পরিষ্কারভাবে শিরক। তাওহীদ বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ কেন্দ্রিক। ইসলামের সকল ইবাদতের লক্ষ্য হ’ল আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামের ধ্যান সাধনার লক্ষ্য হ’ল অন্তর্গুরুকে পাওয়া। যা আল্লাহ থেকে সরিয়ে মানুষকে তার প্রবৃত্তির দাসত্বে আবদ্ধ করে। এদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, ‘আপনি কি দেখেছেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহ বানিয়েছে? আপনি কি তার যিম্মাদার হবেন’? ‘আপনি কি ভেবেছেন ওদের অধিকাংশ শুনে বা বুঝে? ওরা তো পশুর মত বা তার চাইতে পথভ্রষ্ট’ ( সুরা ফুরক্বান, আয়াত ৪৩-৪৪)। মূলতঃ ঐ অন্তর্গুরুটা হ’ল শয়তান। সে সর্বদা তাকে রঙিন স্বপ্নের মাধ্যমে তার দিকে প্রলুব্ধ করে।
২.তাদের দৃষ্টিতে সকল ধর্মই সত্য(তাদের প্রকাশিত বই "হাজারো প্রশ্নের জবাব,কোয়ান্টাম বুলেটিনসমূহ ও কোয়ান্টাম উচ্ছাস) লা হাওলা ওয়াল কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। অথচ আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন," নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম"(সুরা আল ইমরান, আয়াত -১৯)
৩. তারা বলেন, কোয়ান্টাম মেডিটেশনের জন্য ধর্ম বিশ্বাস কোন যরূরী বিষয় নয়। ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের সাথে এর কোন বিরোধ নেই। তাদের কার্যাবলীতে এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ‘এখন কোয়ান্টাম শিশু কাননে রয়েছে ১৫টি জাতিগোষ্ঠীর চার শতাধিক শিশু। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রামা, খ্রিষ্টান, প্রকৃতিপূজারী সকল ধর্মের শিশুরাই যার যার ধর্ম পালন করছে। আর এক সাথে গড়ে উঠছে আলোকিত মানুষ হিসাবে’ (শিশু কানন)।
জবাব : মানুষকে সকল ধর্ম থেকে বের করে এনে কোয়ান্টামের নতুন ধর্মে দীক্ষা নেবার ও কোয়ান্টাম নেতাদের গোলাম বানানোর চমৎকার যুক্তি এগুলি। কেননা অন্তর্গুরুর ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে গেলে একজন আলোকিত গুরুর কাছে বায়াত বা দীক্ষা নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া আধ্যাত্মিকতার সাধনা এক পিচ্ছিল পথ। যেকোন সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাদে পড়ে যেতে পারেন’ (টেক্সটবুক, পৃঃ ২৪৭)। অর্থাৎ এরা ‘আলোকিত মানুষ’ বানাচ্ছে না। বরং ইসলামের আলো থেকে বের করে এক অজানা অন্ধকারে বন্দী করছে। যার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, তা কবুল করা হবে না। ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৮৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছি’ (আহমাদ, মিশকাত হা/১৭৭)। অতএব ইসলামের প্রকৃত অনুসারীরাই কেবল আলোকিত মানুষ। বাকী সবাই অন্ধকারের অধিবাসী।
৪. তারা বলেন, বহু আলেম আমাদের মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং তারা এর সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই বলেছেন।
জবাব : অল্প জ্ঞানী অথবা কপট বিশ্বাসী ও দুনিয়াপূজারী লোকেরাই চিরকাল ইসলামের ক্ষতি করেছে। আজও করছে। ওমর (রাঃ) বলেন, ইসলামকে ধ্বংস করে তিনটি বস্ত্ত : (১) আলেমদের পদস্খলন (২) আল্লাহর কিতাবে মুনাফিকদের ঝগড়া এবং (৩) পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসন’ (দারেমী)। মনে রাখা আবশ্যক যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। অতএব যা তাঁর ও তাঁর ছাহাবীগণের আমলে দ্বীন হিসাবে গৃহীত ছিল, কেবলমাত্র সেটাই দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে। তার বাইরে কোন কিছুই দ্বীন নয়।
৫. মেডিটেশন পদ্ধতি নিজের উপরে তাওয়াক্কুল করতে বলে এবং শিখানো হয় যে, ‘তুমি চাইলেই সব করতে পার’। এরা হাতে মূল্যবান ‘কোয়ান্টাম বালা’ পরে ও তার উপরে ভরসা করে।
জবাব : ইসলাম মানুষকে মহাশক্তিধর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে শিখায় এবং আল্লাহ যা চান তাই হয়। এর মাধ্যমে মুমিন নিশ্চিন্ত জীবন লাভ করে ও পূর্ণ আত্মশক্তি ফিরে পায়। আর ইসলামে এ ধরনের ‘বালা’ পরা জায়েজ নাই
৬.৬. তারা বলেন, শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে এমন এক ক্ষমতা তৈরী হয়, যার দ্বারা সে নিজেই নিজের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে। এজন্য একটা গল্প বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক ইঞ্জিনিয়ার সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সে ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। তারপর সেখানে ভাল একটা চাকুরীর জন্য মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সেখানে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই উন্নতমানের একটা চাকুরী পেয়ে গেল’ (টেক্সট বুক পৃঃ ১১৫)। জবাব : ইসলাম মানুষকে তাকদীরে বিশ্বাস রেখে বৈধভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বলে। অথচ কোয়ান্টাম সেখানে আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে কথিত মনছবির পূজা করতে বলে।
তাই সাবধান হউন৷
ইসলামের দৃষ্টিতে এই কোয়ান্টাম মেথড সংক্রান্ত বিষয়ে জানার জন্য বসুন্ধরা মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী প্রকাশিত "কুরআন সুন্নাহর আলোকে কোয়ান্টাম মেথড ", মাওলানা শফিউল্লাহ ফুয়াদের একজন শিক্ষক দর্শক ও দর্পন বইয়ের ১:১৩৯-১৪২ পৃষ্ঠা,মাওলানা মুহাম্মদ আফসারুদ্দিন রচিত " ইসলাম ও কোয়ান্টাম মেথড "বই,ইন্টারনেটে মাসিক আত তাহরীকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত "কোয়ান্টাম মেথড একটি শয়তানী ফাদ",মুফতি মনসুরুল হকের দারসে মনসুর ওয়েবসাইটের প্রবন্ধ এবং ইউটিউবে ডঃ আবুবকর মুহাম্মদ জাকারিয়া,ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ,ডঃ ইমাম হোসাইন এদের বয়ান আলোচনা শুনতে পারেন
আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন(আমিন)
[চলবে]
Comments
Post a Comment