"১৮ জিলহজ্জের আজকের এই দিনের ঐতিহাসিক ঘটনা"
-----------------------------------------------------------------
"গদিরে খুম দিবসঃ মাওলা আলীর রা. অভিষেক"
---------------------------------------
সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারি
আজ রাত ১৮ জিলহজ্জের রাত। ১৮ই জিলহজ্জ তারিখে ইসলামের ইতিহাসে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যার একটি খুব হৃদয়বিদারক এবং অপরটি আনন্দের। আনন্দের ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েই শুরু করছি।
ক. ১০ হিজরি সনে বিদায় হজ্জ শেষে মক্কা শরিফ থেকে মদিনা শরিফে ফিরছেন দ্বীনের নবী ﷺ। সাথে ১৪ শত সাহাবায়ে কেরাম। ১৮ জিলহজ্জ তারিখে মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি "গদিরে খুম" নামক পানির কুয়ার কাছে এসে কাফেলা পৌঁছাল। আল্লাহর হাবিব ﷺ বললেন, আজ রাত আমরা এই পানির আধারের কাছে যাপন করব। তাবু খাটাও। তাবু খাটানো হল৷ নবী করিম ﷺ বললেন, আমার জন্য মিম্বর বানাও। তোমাদের উদ্দেশ্যে আমার কিছু বলার আছে৷ মিম্বর বানানো হল। সেই মিম্বরে চড়ে প্রথমে আল্লাহ পাকের প্রশংসা করলেন৷ অতঃপর নবী করিম ﷺ বললেন, "আমি একজন মানুষ! আমি আশংকা করি অচিরেই মালাকুল মউত আজরাইল আমার সাথে সাক্ষ্যাৎ করবেন। আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আমি আমার পরে দুটো ভারী বস্তু তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি৷( এই দুটো বস্তুকে তোমরা আঁকড়ে ধরলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না)। প্রথমটি কুরআন মাজিদ। এতে হেদায়াত আছে, আছে নুর। দ্বিতীয়টি আমার আহলে বায়ত, আমার পরিবারের সদস্যবৃন্দ (ইমাম আলি, ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন ও মা ফাতেমাতুজ যাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহুম জামিয়ান, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার স্ত্রীগণ)৷ আমি আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি৷" এই শেষ কথাটি তিনি তিনবার বললেন।
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত জায়েদ বিন আরকাম রা. হতে বর্নিত সহিহ মুসলিমের এই হাদিসখানার অসংখ্য অগুনিত সনদ আছে, যে কারণে অনেক মুহাদ্দিস এই হাদিসকে মা'নান অকাট্য বা মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদিস বলেছেন৷ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬১১৯-৬১২২ তিরমিজি, হাদিস নং- ৩৭৮৮)
একই মঞ্চে অতঃপর প্রিয় নবিজি ﷺ মাওলা আলির রা. হাত মুবারক উপরে তুলে ধরে ঘোষণা করেন,
"من كنت مولاه فعلي مولاه "
"মান কুনতু মাওলাহু ফা আলিয়্যুন মাওলাহ।"
"আমি যার মাওলা আলিও তার মাওলা।"
-তিরমিজি, হাদিস নং-৩৭১৩, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১২১
অপর রেওয়ায়াতে এসেছে, আলিয়্যুন মাওলা কুল্লি মুমিনিন মিম বা'দি। - আলি আমার পর সকল মুমিনের ওলি।
এই হাদিসখানা এত অসংখ্য অগুনিত সনদ ও রেওয়ায়াতে বর্নিত হয়েছে যে অনেক মুহাদ্দিস এই হাদিসকেও মা'নান মুতাওয়াতির বা অকাট্য পর্যায়ের হাদিস বলেছেন।
সেজন্য শায়খ আলবানি সাহেবের মত কট্টরপন্থী লোকও এই হাদিসখানা সহিহ বলতে বাধ্য হয়েছেন, তার সিলসিলাতু আহাদিসি সাহিহাতে, হাদিস নং ১৭৫০ দেখুন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মূলধারার সুন্নী উলামায়ে কেরাম এই বিষয়ে বেশিরভাগই নিরব। আহলে বায়তে আতহারের আলোচনাকে নিচে ফেলার জন্য এখন বেশিরভাগ উলামা গদিরে খুম ও আহলে বায়ত পাক পাঞ্জাতনের আলোচনা করেন না। আর তাদের ভয় এই যে, এটা নিয়ে আলোচনা করলে খেলাফাতের বিষয়ে ঝামেলা চলে আসবে। আসলে সুন্নী অনেক আলিম নিজেরাই ক্লিয়ার না বিষয়টিতে। মাওলা আলির মাওলাইয়াত, ইমামাত ও বেলায়াতকে খেলাফাতের সাথে মেশানোর কোন সুযোগ নেই। খেলাফাত ভিন্ন বিষয়, এটা রাজনৈতিক বিষয় যা প্রিয় নবিজি ﷺ সাহাবাগনের ওপরে ছেড়েছেন। "ওয়া শাবিরহুম ফিল আমর", "ওয়া আমরুহুম শুরা বাইনাহুম।" কুরআন মাজিদের সুস্পষ্ট ও অকাট্য দুইখানা আয়াত। এই আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী সেই পরামর্শ বা শুরার ভিত্তিতেই পরবর্তী চার খলিফা পর্যায়ক্রমে নির্বাচিত হয়েছেন। মাওলা আলির মাওলাইয়াত, ইমামাত ও বেলায়াত সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক বিষয়, যা উনার সন্তান ইমাম মাহদি আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে কেয়ামতের আগে। ইমাম মাহদি আলাইহিস সালামের কাছে এসে খেলাফাত ও বেলায়াত এক বিন্দুতে মিলে যাবে, যেভাবে মাওলা আলির মাঝে মিলেছিল৷ যুগের আধ্যাত্মিক ইমাম উনার বংশ থেকেই হবেন। আর খেলাফাত মুসলমান মেজরিটির মতামতের ভিত্তিতে হবে। খেলাফাতের জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত মূলনীতি হচ্ছে, আল আয়েম্মাতু মিন কুরাইশ। কুরাইশ বংশ হওয়া শর্ত। এর ভিত্তিতেই হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন৷ আর নয়ত আনসার সাহাবি হজরত সা'দ ইবনু উবাদা রা. এঁর খলিফা নির্বাচন প্রায় চুরান্ত হয়ে গিয়েছিল সাকিফা বানি সায়েদাতে৷ হজরত ওমর ফারুক রা. সেখানে আবু বকর সিদ্দিক রা. সহ পৌঁছে বলেন, আনসার কেউ খলিফা হতে পারেন না। খলিফা হবেন কুরাইশ থেকে৷ নবী করিম ﷺর ওসিয়ত৷ তখন সকলে তা মেনে নেন৷ কারণ সবাই জানতেন এটাই ছিল নবী করিম ﷺর ওসিয়ত খেলাফাত সম্পর্কে। কাজেই খেলাফাত ও মাওলা আলির বেলায়াতের মাঝে প্যাঁচ লাগানোর কিছু নেই।
আজ নাসিবি নাজদি সৌদি টাকা খরচ করে মোল্লাদের মাথা নষ্ট করছে যে, আহলে বায়তের আলোচনা করা যাবে না। কারণ তাদের মনের হিংসা। আহলে বায়তের আলোচনা হলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়। জুলুমের উপরে গড়ে ওঠা তাদের রাজত্ব বৈধতা পায় না আহলে বায়তের আলোচনা হলে৷ তাই তারা ইয়াজিদের জুলুমের রাজত্বকে বৈধতা দেয়ার পক্ষে আলোচনা করে৷ সৌদি দরবারি মোল্লাদের অনেকেই, নাউজুবিল্লাহ মিন জালিক, মায়াজাল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ, ইমাম হোসাইন রা. কে বাগি বা বিদ্রোহী বলার মত ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে। এর পেছনে আরো বহু ভূ রাজনৈতিক কারণও আছে।
এজন্য মূলত আমাদের অজ্ঞতা দায়ী।
অপরদিকে শিয়াদের বিভিন্ন কুসংস্কার, বিদয়াতি মনগড়া কথা ও কাজ, বাড়াবাড়ি ও উগ্রতাও এজন্য বহুলাংশে দায়ী। প্রথম তিন খলিফা ও উম্মাহাতুল মুমিনিনগন এবং বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কেরামকে শিয়ারা যা ইচ্ছা তা বলে। এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক সুন্নি মৌলানারাও আহলে বায়ত সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাচ্ছে।
আমাদেরকে কৌশলে বুঝানো হয়েছে যে, আহলে বায়ত পাক পাঞ্জাতন হচ্ছে শিয়াদের আলোচনার বিষয়।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে আহলে বায়তের খাদিম হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
পরিশেষে মজার বিষয় দিয়ে শেষ করছি, গদিরে খুমের এই ডিক্লেয়ারেশনের পর হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. প্রথম সাহাবি ছিলেন, যিনি হজরত আলি রা. কে অভিনন্দন জানান এই বলে, "হে আবু তালিবের সন্তান আলি! তোমাকে অভিনন্দন, তুমি সকল মুমিন মুমিনার মাওলা হয়ে গেলে"।- মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদিস নং ১৮৫০২।
খ. আবার ৩৫ হিজরি সনের এই ১৮ জিলহজ্জ তারিখেই দুর্বৃত্ত বিদ্রোহীদের হাতে ইসলামের ইতিহাসের তৃতীয় খলিফায়ে রাশেদ হজরত ওসমান ইবনে আফফান রা. শহীদ হন। যেই ওসমান ইবনে আফফান রা. এঁর ইসলামের জন্য অবদান অনেক। প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হজরত ওসমান ইবনে আফফান রা. অসংখ্যবার প্রয়োজনের সময়ে ইসলামের জন্য অকাতরে সম্পদ বিলিয়েছেন। যেজন্য তাঁর উপাধী হয় গনি। হজরত ওসমান ইবনে আফফান রা. এঁর নিকটে হুজুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই কন্যাকে (সায়্যিদাহ রুকাইয়া রা. ও সায়্যিদাহ উম্মে কুলসুম রা.) একের ইন্তেকালের পর অপরকে বিয়ে দেন। যেজন্য হজরত ওসমান রা. এঁর উপাধী হয় জুন্নুরাইন বা দুই নুরের অধিকারী।
পিক পরিচিতিঃ গদিরে খুমের ঘোষণার সেই ঐতিহাসিক স্থান।
Comments
Post a Comment