কারবালার যুদ্ধ শেষ। ইয়াজিদের বন্দি শিবির থেকে আহলে বায়তের জীবিত সদস্যগণ বহুদিন পর আবারো মদিনা মুনাওয়ারাতে ফেরত এসেছেন। ইমাম হোসাইন আ. রা. এঁর একমাত্র (আমি যতদূর জানি, ইমাম হাসান আ রা এঁর পুত্র সন্তান আরো জীবিত ছিলেন) জীবিত পুত্রসন্তান ইমাম আলি ইবনুল হোসাইন প্রকাশিত জয়নুল আবেদিন সাজ্জাদ রা. মদিনা শরিফে আবারো বসবাস শুরু করেছেন। উনার মূল নাম হচ্ছে আলি ইবনুল হোসাইন কিন্তু "জায়নুল আবেদিন" বা "ইবাদাতকারীদের সৌন্দর্য" উপাধীতেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। অত্যধিক সেজদা, নামাজ, ইবাদাত বন্দেগী করতেন বলে "সাজ্জাদ"ও উপাধী দেয়া হয় তাঁকে।
যাইহোক, ইমাম জয়নুল আবেদীন রা. আ. মদিনা শরিফে দিন কাটাচ্ছেন৷ কিন্তু কারবালার সেই হৃদয় বিদারক ঘটনা যা তিনি অসুস্থ অবস্থায় তাবু থেকে নিজ চোক্ষে দেখেছেন তা এক লমহার জন্যও ভুলতে পারেন না। অঝর ধারায় দুই চোখে পানি ঝরত যখনই কারবালার কথা মনে পড়ত। এমনকি পানি দেখলেও কান্না করতেন। ইতিহাস, সিরত, তারিখের বিভিন্ন কিতাবে এসেছে, যখন মুহাররাম মাস আসত, তখন নবী পরিবারের সদস্য ইমাম জয়নুল আবেদীন সহ অন্যান্য সদস্য- সদস্যাগণের কান্নার আওয়াজে মদিনাবাসী বুঝে যেতেন মুহাররাম মাস চলে এসেছে। মদিনাবাসীও কান্নার রুল বইয়ে দিতেন আহলে বায়তের ভালোবাসায়। আর এখন আমাদেরকে মুহাররাম মাস আসলেই শেখানো হচ্ছে, ৩ দিনের বেশি শোক নেই, এসব কান্নাকাটি, জারি গাওয়া এগুলো কী? আহলে বায়ত কী তা জানতেন না? হাদিসে আসা মৃতের জন্য ৩ দিনের বেশি শোক নেই মানে জাহেলিয়াতের যুগের মত করে মুখ ও বুকে আঘাত করে, শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করে মাতম করতে নাই। কালো কাপড় কিংবা অন্যান্য শোকচিহ্ন ধারণ করতে নাই। কিন্তু আহলে বায়তের জন্য অশ্রুজল! এতো জান্নাতি নিয়ামত। কাল হাশরের দিনে মিজানের পাল্লায় যোগ হবে এই অশ্রুজল।
যাইহোক, কারবালার ঘটনার প্রায় ২০ বছর পর ইমাম জয়নুল আবেদীন আ. রা. এঁর একজন ক্রীতদাস খাদিম, যে সবসময় তাঁর খেদমতে থাকতেন, তিনি একদিন ইমাম জয়নুল আবেদীনকে কারবালার কথা স্মরণ করে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "হে ইমাম! কারবালার ঘটনার তো আজ প্রায় ২০ বছর গত হয়ে গেল। আপনার চোখের পানি কি তবে আর কখনোই ঘুচবে না?"
আমাদের সুন্নী হুজুররাও কেউ কেউ এখন যা বলেন আর কি! শোক তো ৩ দিন। এমনই কিছু একটা বলতে চাইলেন খাদিম৷
ইমাম জয়নুল আবেদিন আ. রা. বলেন, ২০ বছর হয়ে গেছে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার, তুমি কথা বলেছ সত্য। তবে জেনে রাখ, হজরত ইয়াকুব আ. এঁর ১২ সন্তানের এক সন্তান মাত্র হজরত ইউসুফ আ. হারিয়ে গিয়েছিলেন। মারা যান নাই৷ কতল হন নাই। শহীদ হন নাই। ভাইদের চক্রান্তে হারিয়ে গিয়েছিলেন কেবল। তাতেই হজরত ইয়াকুব আ. একটি আলাদা ঘর নির্মাণ করে তার মাঝে বসে দিনরাত হজরত ইউসুফ আ. এঁর জন্য কাঁদতেন। ৪০ বছর পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে ইয়াকুব আ. এর চোখে ছানী পড়ে যায়। (ইউসুফ আ. পরে তাঁর জামা পাঠান মিসর থেকে যা ইয়াকুব আ. এঁর চোখে বুলানোতে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে, সূরা ইউসুফ ১২ নং সূরা পড়ে দেখতে পারেন)
ইমাম জয়নুল আবেদিন বলতে লাগলেন, এক সন্তান হারিয়ে ইয়াকুব আ. কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যান। আর আমি আলি জয়নুল আবেদিনের চোখের সামনে আমার কলিজার টুকরো বাবা ইমাম হোসাইন শহীদ হন। ৬ মাস বয়সের দুধের শিশু ভাই আলি আসগরকে কোলে করে আমার বাবা পানি পান করাতে নিয়ে যান ফোরাত তীরে, সেই শিশু সন্তানকে ইয়াজিদ বাহিনী তীর মেরে শহীদ করে। আমার টগবগে যুবক ভাই আলি আকবর কে তারা নির্মমভাবে শহীদ করে। আমার রাজপুত্রের মত সুন্দর চাচাত ভাই কাসেম বিন হাসানকে তারা শহিদ করে৷ আমার ৪ চাচাকে তারা শহীদ করে৷ চাচাত ভাইদেরকে শহীদ করে। অসংখ্য অগুনিত রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনকে আমি হারাই এই কারবালার জমিনে মুহাররাম মাসে।
শুধুমাত্র তাই না৷ এখানেও থামে নাই ইয়াজিদ বাহিনী। তাদের শির কেটে নিস্তার হয়নি। সেই শিরকে বর্শার আগাতে বিদ্ধ করে দামেশকে ইয়াজিদের কাছে পেশ করা হয়েছে। তাঁদের শরীরের উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে শরীর মুবারাকগুলোকে থেথলে দেয়া হয়েছে কারবালার নিদারুন প্রান্তরে।
(জানি না কিসের বদলা কিসের প্রতিশোধ নিচ্ছিল ইয়াজিদ বাহিনী! ওহ! হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বদরের যুদ্ধে মাওলা আলি ও আমির হামজা রা. এঁর হাতে নিহত ইয়াজিদের দাদী হিন্দার ভাই বাবা ওতবা, ওয়ালিদ, শাইবা জাহান্নামীদের হত্যার প্রতিশোধ হয়ত। যা সে স্পষ্টভাবে বলেছে ইমাম হোসাইন আ. রা. এঁর শির মুবারক সামনে নিয়ে কবিতার আকারেঃ
তথ্যসূত্রঃ
১. তারিখে ইবনে জারির তাবারি, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-১৮
২. তারিখে ইবনে জারির তাবারি, ১০ ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৬০
৩. আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে কাসির, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৩৮১, ইমাম হোসাইন রাঃ এর শির মুবারক পরিচ্ছেদে সংক্ষেপে এনেছেন কবিতাটি। (বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত সংস্করণ দেখুন)
৪.হাফিয ইবনু আসাকির তার তারিখে দামেশকে বিস্তারিত এনেছেন
৫.আল আওয়াসিমু মিনাল কাওয়াসিম,পৃষ্ঠা নং ২৩২.)
ইমাম জয়নুল আবেদিন প্রশ্ন করলেন, "হে আমার খাদিম! আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ আমার চোখের পানি বন্ধ হবে কবে?"
যদি আপনার অন্তরে আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসা থাকে তবে আপনি শোকাক্রান্ত অটোমেটিক হবেন। এটা আনুষ্ঠানিকতার কোন বিষয় নয়৷ হৃদয় থেকে অনুভবের বিষয়। ঘোষণা দেয়া না দেয়ার কোন বিষয় না।
আর আমি অধমকে এসব ফতোয়া দিতে আসবেন না। আমার নামের আগে দেখছেন নিশ্চয়ই সৈয়দ লাগানো। আমরা এই বংশের সন্তান। আমরা বংশ পরম্পরায় জেনে এসেছি আমাদের কাছে এটা মুতাওয়াতির বা অকাট্য যে, মুহাররাম মাস আমাদের পূর্বপুরুষের কুরবানীর মাস, তাই এ মাস আমাদের জন্য দুঃখের কষ্টের, অশ্রু বিসর্জন দেয়ার৷ এই মাসে আমরা আনন্দ উৎসব করি না। কাজেই আমরা পারিবারিকভাবে বংশ পরম্পরায় আপনাদের মোল্লাগিরি ফতোয়ার নিকুচি করি।
কৃতঃ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী
Comments
Post a Comment