কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার ৫০ বছর পর ইমাম হোসাইন রা. আ. এঁর নাতি এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন আলি ইবনুল হোসাইন আ. রা. এঁর সন্তান ইমাম জায়েদ বিন আলী রা. আ. ওমাইয়া দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু করলেন। ওমাইয়াদেরকে উৎখাত করতে ইমাম জায়েদ বিন আলী রা. প্রিয়নবীর ﷺ আহলে বায়ত প্রেমিকদেরকে একত্রিত করছেন। খবর পেয়ে আমাদের হানাফি মাজহাবের ইমাম, ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা রাহ. ১০ হাজার দিরহাম বা রৌপ্যমুদ্রা প্রেরণ করেন তাঁর সরাসরি ওস্তাদ ইমাম জায়েদ বিন আলির রা. নিকট জালিম ওমাইয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সেই যুদ্ধে সাহায্য স্বরুপ। ওমাইয়াগুষ্টি অপপ্রচার করতে লাগল, "ইমাম আবু হানিফা রাফেজি শিয়া হয়ে গেছেন"। উল্লেখ্য, ইমাম আবু হানিফা রাহ. আহলে বায়তের নয়জন ইমামের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন বলে উল্লেখ আছে। তিনি বলতেন, "লাওলাস সানাতান লা হালাকান নু'মান"। "যদি সেই দুই বছর না হত (আহলে বায়তের ইমামগণের খেদমতে থাকা আমার জীবনের ২ বছর), তবে নু'মান ইবনে সাবিত আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত।" পরবর্তীতে ওমাইয়া জালিমদের হাতে শাহাদাতপ্রাপ্ত (১২২ হিজরী সনে) ইমাম জায়েদ বিন আলি আ. এঁর লাশ মুবারকই আব্বাসিয়দের সবচাইতে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে ওমাইয়াদেরকে উৎখাত করতে। আহলে বায়তের বিরুদ্ধে হওয়া জুলুমের বদলা ও আহলে বায়তের সুশাসন ফিরিয়ে আনার নাম করে তারা আহলে বায়ত প্রেমিকদেরকে একত্রিত করে এবং ওমাইয়াদের চূরান্ত পতন ঘটায়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আব্বাসিয়রাও যেই লাউ সেই কদু হয়ে দাঁড়ায়। ওমাইয়াদের মতই আহলে বায়তের উপর জুলুম অব্যহত রাখে। আহলে বায়তের বহু ইমামকে তারা বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। ইমাম হাসান আ. এঁর আওলাদ ইমাম নাফসে জাকিয়্যাহ রা. তাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু করলে, ইমাম নাফসে জাকিয়্যাহ রা. কেও আব্বাসিয়রা ১৪১ হিজরি সনে নির্মমভাবে শহীদ করে।
যাইহোক আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি, আমাদের সুন্নী ইসলামের অন্যতম মাজহাব শাফিই' মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম শাফিই রাহ. নবীর ﷺ আহলে বায়তের শানে কাসিদা লিখেন বেশি বেশি। আহলে বায়তের আলোচনা বেশি বেশি করেন। তিনি তাঁর দিওয়ানে শাফিই'তে লিখলেন,
"ইয়া আ-লা বাইতি রাসূলিল্লাহি হুব্বুকুমু,
ফারদুম মিনাল্লাহি ফিল কুরআনি আনজালাহু,
ইয়াকফিকুমু বিয়া'যিমিল ফাখরি বিআন্নাকুমু,
মান লাম ইউসাল্লি আলাইকুমু লা সালাতা লাহু"
অর্থ্যাৎ "হে রাসূলুল্লাহ ﷺর পরিবার আপনাদের ভালোবাসা আল্লাহ পাক ফরজ করেছেন, কুরআন মাজিদে আয়াত নাজিল করে,
আপনাদের মর্যাদা বর্ণনার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, যে আপনাদের উপর দরুদ পড়বে না, তার নামাজই কবুল হবে না!"
আব্বাসিয়গুষ্টি, নাসেবি (নবী পরিবার তথা আহলে বায়ত বিরোধী একটা দল ও মতবাদ, যা ওমাইয়াদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে) গুষ্টি প্রপাগাণ্ডা শুরু করে দিল, "ইমাম শাফেই' রাহ. রাফেজি শিয়া হয়ে গেছেন"। তাদের অপবাদ ও মিথ্যা প্রপাগান্ডাতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ইমাম শাফিই রাহ. আবারো কবিতা লিখলেন, তাঁর নিজের লিখিত কবিতাসমগ্র "দিওয়ানে শাফিই"তেই লিপিবদ্ধ আছে,
"লাও কানা হুব্বু আ-লে মুহাম্মাদিন রাফদান,
ফাল ইয়াশহাদিস সাকালান, আন্নি রাফেদি"
"যদি মুহাম্মদ ﷺর পরিবারের ভালোবাসা রাফেজিয়াত শিয়াবাদ হয়,
তবে জ্বীন ও মানবজাতি স্বাক্ষ্য থাকুক আমি রাফেজি শিয়া!"
আমরা সুন্নীদের ৬খানা বিশুদ্ধ হাদিসের কিতাবের অন্যতম কিতাব নাসাই শরীফের সংকলক ও যুগশ্রেষ্ঠ হাদিসের ইমাম নাসাই রাহ., যার লক্ষ লক্ষ হাদিস সনদ মতনসহ মুখস্থ। তিনি একবার সিরিয়ার দামেশকে আসলেন। মসজিদে বসে তাঁর লিখিত "খাসায়েসে আলি বা মাওলা আলির মর্যাদা" নামক কিতাব থেকে একে একে অনেকগুলো হাদিস বর্ণনা করলেন। মসজিদে উপস্থিত ওমাইয়াদের দোসর নাসেবিগুষ্টি বলল, এখন আমির মুয়াবিয়া রা. এঁর শানে অনুরুপ হাদিস বলুন। ইমাম নাসাই রাহ. বললেন, আমির মুয়াবিয়া রা. এঁর শানে এরকম হাদিস নেই। নাসেবিগুষ্টি বলল, না আপনাকে বলতেই হবে আমির মুয়াবিয়া রা. এঁর শানে হাদিস। ইমাম নাসাই রাহ. বললেন, আল্লাহর হাবিব ﷺ যদি আমির মুয়াবিয়া রা. এঁর শানে হাদিস না বলে থাকেন আমি কোথা থেকে আনব?
তারা এই কথা শুনে ইমাম নাসাই রাহ. কে পাথর মেরে মেরে শহীদ করে দিল। আর বাজারে চাওর করে দিল "ইমাম নাসাই রাফেজি শিয়া হয়ে গেছেন"। ইমাম নাসাই রাহ. এঁর জীবনি যারাই লিখেছেন তাঁর শাহাদাতের একমাত্র কারণ হিসেবে এই ঘটনাকেই এনেছেন৷ আহলে হাদিসদের ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবও এই ঘটনা এনেছেন ইমাম নাসাইর রাহ. জীবনিতে৷
ইমাম হাকিম নিশাপুরী রাহ. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের বড় একজন ইমাম হাদিসের ময়দানের। তিনি বুখারী ও মুসলিম শরিফে যেসকল সহিহ হাদিস আসে নাই অথচ ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম রাহ. এঁর শর্তানুসারে সেগুলো সহিহ, এমন সকল হাদিস একত্রিত করে "মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন" নামে বিখ্যাত এক হাদিসের কিতাব রচনা করেন। বিখ্যাত বলতে মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের নিকট বিখ্যাত, আমজনতার নিকট নয়৷ সেই হাদিসের কিতাবে আহলে বায়তের শানে অসংখ্য অগুণিত হাদিস আনলেন। সায়্যিদাহ ফাতেমাতুজ জাহরা রা. এঁর শানে আলাদা করে "মানাকিবে ফাতেমা" নামে একখানা স্বতন্ত্র হাদিসের কিতাব রচনা করেন। মার্কেটে প্রচার করে দেয়া হল, "ইমাম হাকিম নিশাপুরী রাহ. রাফেজি শিয়া হয়ে গেছেন"।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! এসব নতুন কিছু নয়৷ পুরাতন টেকনিক। আহলে বায়তের ভালোবাসার কথা, তাঁদের শান- মান মর্যাদা, যে কুরআন সুন্নাহের আলোকে বেশি বেশি গাইবে, তাকে শিয়া রাফেজি হওয়ার অপবাদ নিয়েই মৃত্যবরণ করতে হবে। এটা যুগ যুগ ধরে হয়ে এসেছে। যারা শিয়া রাফেজি ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মাঝে পার্থক্য কী তা জানে না, সেরকম অজ্ঞ জাহিলরা এসব বিশ্বাস করবে এবং প্রচার করবে এটাই স্বাভাবিক।
শিয়া রাফেজি কারা? এই সংজ্ঞাটা কী আমরা জানি? কোথা থেকে এসেছে এই রাফেজিয়াত? শিয়া রাফেজি হচ্ছে তারা, যারা প্রথম তিন খুলাফায়ে রাশেদ হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. হজরত ওমর ফারুক রা. হজরত ওসমান জুন্নুরাইন রা. এঁর খেলাফাতকে অবৈধ মনে করে অস্বীকার করে। যারা বিশ্বাস করে মাওলা আলি আ. এবং তাঁর ছোট সাহেবজাদা ইমাম হোসাইন আ. রা. এঁর রক্তধারা ছাড়া এর বাহিরে আর কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ইমাম হতে পারবে না। রাফেজি হচ্ছে তারা, যারা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবা হজরত জুবায়ের ইবনুল আওয়াম রা., হজরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. সহ অসংখ্য অগুনিত সাহাবাকে যা ইচ্ছা তা গালাগালি করে, লানত দেয়। শিয়া রাফেজি হচ্ছে তারা যারা উম্মুল মুমিনিন সায়্যিদাহ আয়েশা বিনতে আবি বকর সিদ্দিকা রা., সায়্যিদাহ হাফসা বিনতে ওমর রা. কে গালাগালি করে, লানত দেয়। এক কথায়, অল্প কজন সাহাবা বাদে বেশিরভাগ সাহাবায়ে কেরাম মুরতাদ হয়ে গেছেন বলে যারা বিশ্বাস করে তারা হচ্ছে শিয়া রাফেজি, বেশিরভাগ সাহাবায়ে কেরামকে তারা মুনাফিক মনে করে মাওলা আলি আ. কে প্রথম খলিফা না বানানোর কারণে। মায়া'জাল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহাল আজিম।
এখন আমরা যারা কোন একজন সাহাবিকেও গালাগাল দেব, মায়াজাল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ, দূরের কথা, লানত করব মায়াজাল্লাহ দূরের কথা, আমরা যারা সারাদিন খুলাফায়ে রাশিদিনসহ অন্যান্য জলিল কদর সাহাবায়ে কেরামের শান মান মর্যাদা বর্ণনা করি, খুলাফায়ে রাশিদিনের খেলাফাতকে ১০০% বৈধ মনে করি এবং সেসবের পক্ষে দলিল দিই, হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. কে শ্রেষ্ঠ সাহাবি মানি, উম্মাহাতুল মুমিনিনগণের শান মান মর্যাদা বর্ণনা করি, অন্যান্য জলিল কদর সাহাবায়ে কেরামের শান মান মর্যাদা সম্পর্কে লেখালেখি করি, আলোচনা করি, আমাদেরকেও শিয়া রাফেজি হওয়ার অপবাদ দেয়া হচ্ছে। এমনকি আমরা তো যেই সাহাবিকে নিয়ে সবচাইতে বেশি বিতর্ক সেই আমির মুয়াবিয়া রা. এঁর ভুলগুলোকেও ইজতিহাদি ভুল বলছি, তাঁর সম্পর্কেও বাজে মন্তব্য কিংবা লানত গালাগালি কিছুই করি না৷ সাহাবি মেনে জবান বন্ধ রাখি উনার ব্যাপারেও৷
তাহলে আমাদের অপরাধ কী? সেই পুরাতন নাসেবী রোগ! আহলে বায়তের শান মান মর্যাদা এত কেন বলেন? আহলে বায়ত সম্পর্কে কেন সমাজের মানুষ এত জানবে? কারবালার সত্যতা কেন সমাজে প্রচার করছেন?
আচ্ছা, ওমাইয়া আব্বাসিয়রা না হয় তাদের রাজত্বের জন্য ভীত ছিল এই কারণে যে, আহলে বায়তের আলোচনা শান মান প্রচার বেশি হলে, আহলে বায়তের প্রেম মানুষের অন্তরে জাগ্রত হলে আমাদের জুলুমের উপরে গড়া অবৈধ তখত হয়ত উল্টে দেবে মানুষ। কিন্তু আপনারা ভীত কেন? কী নিয়ে?
আপনাদের অপপ্রচার মিথ্যা প্রপাগান্ডতে এই জবান ইন শা আল্লাহ বন্ধ হবে না৷ কাল কেয়ামত পর্যন্ত আহলে বায়ত, পাক পাঞ্জাতন প্রেমিকেরা আহলে বায়তের শান- মান মর্যাদা ও ভালোবাসার পতাকাকে বুলন্দ করেই যাবে ইন শা আল্লাহ৷ কারণ মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে মাওলা আলির আ. ভালোবাসা, তা আমরা জেনে গেছি৷ "মুমিন ছাড়া আলিকে কেউ ভালোবাসবে না, আর মুনাফিক ছাড়া আলিকে কেউ হিংসা করবে না" (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪৩, আল হাদিস এন্ড্রয়েড এপ্স) কাজেই ইমান ও নেফাকের মানদন্ড মাওলা আলি আ. আমরা তা জেনে গেছি। অন্য কোন নতুন আপনাদের বানোয়াট মানদণ্ড আমাদেরকে গেলাতে পারবেন না। আমরা প্রিয়নবী ﷺর শেখানো ইমানী মানদন্ড নিয়েই মরব ইন শা আল্লাহ।
আর শেষ করছি, উপরোল্লিখিত শিয়া রাফেজি অপবাদপ্রাপ্ত ইমাম হাকিম নিশাপুরী রাহ. এঁর হাদিসের কিতাব মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইনের একখানা হাদিসের মাধ্যমেঃ
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, প্রিয়নবী ﷺ বলেন,
فلو أن رجلا صفن بين الركن و المقام فصلى و صام ثم لقي الله و هو مبغض لأهل بيت محمد دخل النار
هذا حديث حسن صحيح على شرط مسلم و لم يخرجاه
تعليق الذهبي قي التلخيص : على شرط مسلم
"যদি কোন ব্যক্তি কাবার রুকনে ইয়ামানি ও মাকামে ইবরাহীমির মাঝে নামাজরত, রোজা ও ইতিকাফ অবস্থায়ও মারা যায়, আর তার মাঝে মুহাম্মদﷺর আহলে বায়তের প্রতি হিংসা থাকে তবে সে জাহান্নামে যাবে।" (হাদিস নং ৪৭১২) শায়খ ইবেন তাইমিয়ার ছাত্র ইমাম জাহাবি রাহ. তার তালখিসে বলেন, এই হাদিস ইমাম মুসলিম রাহ. এঁর শর্তানুসারে সহিহ।
কৃতঃ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী
Comments
Post a Comment