হাসনাইন: নবিজীর দুই ফুল
সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
==================
১০ ই মহররম ৬১ হিজরি। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদরের দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন তৎকালীন উমাইয়া শাসক ইয়াযিদের বাহিনীর হাতে। ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার। তাই এই দিনটি এলে মুমিন হৃদয় ব্যাথায় কাতর হয়ে উঠে। কারবালা থেকে শিক্ষা নেয়, জীবন যেতে পারে তবুও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না হোসাইনের অনুসারীরা। মিথ্যার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিবে না। সত্যের জন্য একজন মুমিন লড়ে যাবে জীবন দিয়ে হলেও। তাদের প্রতি আমাদের গভীর প্রেম৷ ভালোবাসার চেতনাই হলো,আর্দশিক লড়াইয়ে নিজেকে হোসাইনের মতো দৃঢ়চেতা করা। আহলে বাইতের প্রতি আমাদের মহব্বত চিরকাল চেতনার ভাস্বর হোক।
প্রিয় নবীর নাতি হিসেবে এমনিতেই ইমাম হোসাইনের (রা.) প্রতি সব মুমিনের অফুরন্ত ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক, তদুপরি কোরআন-হাদিসে আহলে বায়েতের প্রতি বিশেষ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ ইমানের পরিচায়ক হিসেবেও নির্ধারিত হয়েছে।
'আহলে বাইত’ হলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর ও আত্মীয়-স্বজন। 'আহলে বাইত’পারিভাষাটি পবিত্র কোরআনে দুবার এসেছে।
ইরশাদ হয়েছে, 'তারা বলল (ফেরেশতারা) তুমি কি আল্লাহর কোনো কাজে বিস্ময়বোধ করছ, তোমাদের ওপর সর্বদা আল্লাহর রহমত ও তাঁর অনুগ্রহ রয়েছে হে আহলে বাইত। অবশ্যই তিনি মহা প্রশংসিত ও মহামর্যাদাবান(সুরা : হুদ, আয়াত : ৭৩)
'হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পূর্ণরূপে পূতপবিত্র রাখতে।'(সূরা আহজাব : ৩৩)।
প্রিয় নবী রসুল্লাহ (সা.) বলেছেন,'হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে।' (ইবন মাজাহ)। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,'হাসান-হোসাইন (রা.) জান্নাতের যুবকদের সরদার। (তিরমিজি)।
অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,'আমার আহলে বায়েতের মর্যাদা নুহ নবীর কিস্তিতে আরোহীদের মতো'। (মুসনাদে আহমাদ)।
হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইমাম হোসাইন (রা.) তাকে অযোগ্য হিসেবে মনে করতেন বিধায় তার হাতে বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। হজরত হাসান (রা.) ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খিলাফতের ন্যায়সংগত দাবিদার হোসাইন (রা.)। ইন্দ্রিয়পরায়ণ, নীতিজ্ঞানহীন ইয়াজিদের কাছে তিনি জীবনের বিনিময়েও মস্তক অবনত করতে রাজি ছিলেন না।
ইমাম হাসান ও হোসাইন এর প্রতি আমাদের আস্থা ভক্তি ভালবাসা আমাদের ঈমানের অংশ। প্রিয়তম হাসনাইনের ন্যায় নীতি আর্দশ সাহসিকতা জান্দাদিল মুমিনের শাহাদতের প্রেরণা। ভালবাসার পরম ঠিকানা।
সাইয়েদ আলী মিয়া নদভী রহ এর ভাষায়,"আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অনন্য বিশেষত্ব যে, আমরা সাহাবায়ে কেরামের প্রতি, তাদের ফযীলত ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা আহলে বাইতের প্রতি মহববত পোষণ করি। আর আমাদের এই প্রাচুর্য নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। এটাই ছিল হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. এবং তার বংশধরদের মতাদর্শ। এ মতাদর্শটি লালন করতেন হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী রাহ.। পরবর্তীতে মহান সংস্কারক হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ এর মাঝে এই মতার্দশ আমরা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করেছি। কেবল আহলে বাইত খান্দানের কারণে তিনি রায়বেরলীর সৈয়দ খান্দানকে যে সম্মান ও সম্বোধন করতেন, ইতিহাসে এর নজির বিরল।
আমি এখন আপনাদের বলছি, আল্লাহ তাআলা এই পদ্ধতিতেই আদর্শ ধারাটি চালু রেখেছেন। এ ধারারই পর্যায়ক্রম ছিল হযরত হাসান রাযি. ও হযরত হোসেন রাযি.-এর পদক্ষেপ। পরিষ্কার ভাষায় বলছি, হযরাত হাসানাইন (হাসান ও হোসাইন) রাযি.-এর পদক্ষেপ ছিল আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা যে বিশেষ বিশেষ মুআমালা করেছেন এবং তাঁকে দুনিয়ার সর্বোত্তম যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে এই দুটি ফুলেরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। তাদেরকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘রায়হানাতাই রাসূলিল্লাহ’-রাসূলুল্লাহর দুই ফুল।
আমি আমার ইতিহাস অধ্যয়নের আলোকে বলতে পারি, হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর সঙ্গে হযরত হাসান রাযি. যে আচরণ করেছেন, যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা ছিল সম্পূর্ণ সঠিক। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসানের দিকে তাকিয়ে ইরশাদ করেছিলেন-
إن ابني هذا سيد وسيصلح الله به بين فئتين من المسلمين
আমার এই ছেলে (বংশধর) নেতা হবে। আশা করি আল্লাহ তাআলা তার মাধ্যমে মুসলমানদের বড় দুটি দলের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেবেন।-আল ইসাবা খন্ড-১ পৃষ্ঠা-২৩০
আমি পড়েছি, স্পষ্ট মনে আছে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাহ.-এর পিতার (হযরত শায়খ আব্দুল আহাদ সেরহিন্দী রাহ.) ইন্তেকালের সময় যখন ঘনিয়ে এল, একদম উর্ধ্বশ্বাস জারি হয়ে গেল তখন মুজাদ্দিদে আলাফেসানী বললেন, আববাজান! আপনি তো বহুবার বলেছেন, আহলে বাইতের প্রতি মহববত পোষণ মানুষের ঈমানসহ সুন্দর মৃত্যুর ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রাখে।’ উত্তরে তার আববা বললেন-আমি তো সেরকমই দেখতে পাচ্ছি।’
ওই কিতাবে এ ঘটনা বর্ণনার পর পরই এই কবিতাটি লেখা হয়েছে-
الہى بحق بنى فاطمہ + كہ بر قول ايماں كنى خاتمہ
অর্থ : হযরত ফাতেমা রাযি.-এর সন্তানদের অসিলায় হে আল্লাহ!/ঈমানসহ আমাদের মৃত্যু দান কর।
এই মতাদর্শই আমাদের শিআর-ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। কোনো মূল্যের বিনিময়েই এ মতপথ আমরা ছাড়তে প্রস্ত্তত নই। এই ধারাবাহিকতার সঙ্গেই আমরা খোলাফায়ে রাশেদীনকে (সব মানুষের মাঝে খেলাফতের সবচেয়ে বেশি হকদার) বিশ্বাস করি। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যও এই ধারাবাহিকতার সঙ্গে নির্ধারিত বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. দ্বিতীয় হযরত ওমর ফরূক রাযি. তৃতীয় হযরত উসমান গণী রাযি. এবং চতুর্থ হযরত আলী রাযি.-এই ধারাবাহিকতার প্রতি আমরা বিশ্বাস পোষণ করি। আমরা তাদের ধারাবাহিকতা, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও খেলাফতের সত্যতার ব্যাপারে পূর্ণ আস্থাশীল। একই সঙ্গে আমরা আহলে বাইতের প্রতিও মহববত পোষণ করি এবং হযরত হাসান-হোসাইন রাযি.-এর পদক্ষেপকে সম্পূর্ণ সঠিক মনে করি।
আমাদের নির্ভরযোগ্য মুজতাহিদ ও ইমামদের সবাই ইয়াযীদের মাধ্যমে অনাচার ও পাপাচার সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে দ্বিধাহীন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. সম্পর্কে পরিষ্কার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সাহেবযাদা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আববাজান! কেউ কেউ বলে যে, আপনি ইয়াযীদকে পছন্দ করেন। তিনি উত্তর দিলেন, বেটা! যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ও আখেরাতের ওপর বিশ্বাস করে সে কি ইয়াযীদকে পছন্দ করতে পারে? সাহেবযাদা তাকে বললেন, তাহলে তাকে লা'নত করেন না কেন? তখন তিনি বললেন, তুমি তোমার বাবাকে কখনও কারও প্রতি লা'নত করতে শুনেছ? (ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৪৪৩)
ইমাম ইবনে তাইমিয়ারও মতাদর্শ ছিল এটাই। যখন তাতারী নেতা বোলায়ীর সঙ্গে তার কথোপকথন হয় তখন তিনি ইয়াযীদ সম্পর্কে কঠোর নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করেন। বোলায়ী তখন ইয়াযীদপ্রীতি থেকে নিজের দূরত্বের কথা ব্যক্ত করে এবং ইয়াযীদের কর্মকান্ডের ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে। (ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৫১১)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাহ. শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. এবং আমাদের সব পূর্বসূরীর মতাদর্শ ও মাসলাকও ছিল এটাই। ইমামে আহলে সুন্নত মাওলানা আব্দুশ শাকুর রাহ.কে আমি জানতাম। আহলে বাইতের প্রতি, হযরত হোসাইন রাযি.-এর প্রতি তার গভীর মহববত ছিল। এমনকি আহলে বাইতের সঙ্গে সম্পর্কিত ও যুক্তজনদের প্রতিও তাঁর কী পরিমাণ ভালোবাসা ছিল-সেটা সবাই জানি।
এই বিশেষত্ব থেকে আমাদেরকে কখনো দূরে সরানো যাবে না। এ বিষয়ে আমাদের কখনো কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া চলবে না। না সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সম্মাননার বিষয়ে, না খোলাফায়ে রাশেদীনের ধারাক্রমের বিষয়ে এবং না হযরত হাসান-হোসাইন রাযি.-এর কর্মের সঠিকতা ও তাদের পদক্ষেপের শুদ্ধতা ও বরকতময়তা সম্পর্কে। এসব বিষয়ে তাদের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধার অটুট অবস্থান বজায় রাখতে হবে।”
ইমাম হোসাইন রাযি প্রেম ও আর্দশিক লড়াই যুগে যুগে মুমিনের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। সব অসত্য অবিচার অনাচার এবং জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার লড়াই কেয়ামত পর্যন্ত ইতিহাস হয়ে থাকব। মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের লড়াইয়ে হাসনাইন মিল্লতের আর্দশ। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আহলে বাইতের চেতনা চিরকাল আলোর মিনার। বাতিল শক্তি তাদের শক্তি দিয়ে পরাস্ত করেও বিজয় বিজয়ী হয়েছেন চেতনার শানিত ধারায়।
Comments
Post a Comment