সাকরাইন,ও স্কুল কলেজে র্যাগ ডের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রসঙ্গ: ইসলাম কী বলে?
লেখক: আহসান উদ্দিন
আমাদের এই বাংলাদেশ একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। কিন্তু এই দেশে গত কয়েক দশক ধরে এমনসব দুর্বোধ্য বিতর্কিত দিবস উৎসব পালন করতে দেখা যায় যার সাথে ইসলাম বিধৌত বাঙালি সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায় না।জানুয়ারি মাসে সাকরাইনের নামে শব্দদূষণ,ফেব্রুয়ারী মাসে ভ্যালেন্টাইন ডে নামক জঘন্য দিবস,গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্তসহ বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক উৎসবের নামে আল্লাহ ও তার রাসূল সাঃ এর বিধান ভুলে যাওয়া,বিভিন্ন জাতীয় দিবসে(২১ফেব্রুয়ারি,২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস,১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস) ও বিবাহ অনুষ্ঠান বা এজাতীয় আনন্দ অনুষ্ঠানে অশালীন গান বাজনা বেহায়াপনা ও ব্যান্ডপার্টি বাদ্য বাজনা বাজিয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়া,স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগ ডের নামে বেহায়াপনা অপসংস্কৃতি ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। এ প্রবন্ধে প্রথমত ইসলামের মানদন্ডে সাকরাইন প্রসঙ্গে পরে র্যাগ ডে প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
আমি থাকি সূত্রাপুর এলাকায়। সূত্রাপুর গেন্ডারিয়া বা এজাতীয় এলাকা পুরান ঢাকার অন্তর্ভুক্ত। জানুয়ারি মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন পালিত হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালে একে মকর সংক্রান্তি নামে অভিহিত করা হয়।পাকিস্তানের পাঞ্জাবসহ দুয়েকটা প্রদেশে একে বসন্ত মেলা বলা হয়। বাংলাদেশের সব জায়গায় এই সাকরাইন হয় না। মূলত ঢাকা শহরের যে এলাকায় আমি থাকি অর্থাৎ পুরান ঢাকায় এই সাকরাইন পালিত হয়।বাংলাদেশের সাকরাইনের সাথে পাকিস্তানের কথিত বসন্ত মেলার অনেক মিল পাওয়া যায়।মূলত ১৭৪০ সালে মোঘল আমলে ১৪/১৫ জানুয়ারির দিনে পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানো হত। সে থেকেই এই প্রচলিত সাকরাইনের উৎপত্তি হয়।তবে সাকরাইন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ বলছে এটা পুরান ঢাকার উৎসব আবার কেউ বলছে এটা হিন্দুদের উৎসব দিবস।যে কারণে এটা দুইদিন পালিত হয়। ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ। 'মকরসংক্রান্তি' শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী 'সংক্রান্তি' একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের পুরান ঢাকার মত ভারতের গুজরাট,পাঞ্জাব,হরিয়ানা,কেরালা,রাজস্থান,মহারাষ্ট্রে ১৪/১৫ জানুয়ারিতে মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়।মূলত হিন্দু ধর্ম মতে, দেবতাদের ১ দিন মানুষের ১ বছরের সমান। তাই মানুষের হিসেবে নাকি দেবতারা ৬ মাস ঘুমায়, আর ৬ মাস জেগে থাকে!
হিন্দু ধর্ম মতে পৌষ মাসের শেষ দিন দেবতারা গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে। তাই এ সময়টাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শুভ মনে করে!! এ দিনটি শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নয়, বরং সূর্যকে দেবতা মনে করে এমন সকল ধর্মাবলম্বীরাই এ দিবসটি পালন করে, যদিও তারা ভিন্ন নাম ব্যবহার করে। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের হিন্দুরা একে তীরমুরি নামে উদযাপন করে(তথ্যসূত্র-উইকিপিডিয়ার বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ)
পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের হিন্দুরা একে তীরমুরি নামে উদযাপন করে।বাংলাদেশের পুরান ঢাকার সাকরাইন বা পৌষ সংক্রান্তি , ভারতের মকর সংক্রান্তি ও পাকিস্তানের লাহোরে বসন্ত মেলা এই তিনটি দিবস উৎসবেই ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়।অনেকে বসন্ত মেলা বিষয়ে জানেন না৷ পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর,ফয়সালাবাদ ইত্যাদি ছোটবড় এলাকায় জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বসন্ত মেলা উদযাপিত হয়,সেখানে ঘুড়ি উড়ায়,উচ্চৈস্বরে গান বাজনা নাচানাচি,নারী পুরুষ অবাধ সংমিশ্রণ দেখা যায়। একে আবার হিন্দুরা বসন্ত পঞ্চমী বলে ৷ইতিহাসের আলোকে জানা যায় মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের (তৎকালীন অখন্ড ভারতবর্ষে) লাহোরে তৎকালীন মোঘল শাসক জাকারিয়া খানের শাসনামলে হাকিকত রায় নামে এক বিধর্মী মহানবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ ও উম্মুল মুমিনীন হযরত বিবি ফাতিমা যাহরা(রাঃ) এর বিরুদ্ধে অবমাননা ও বেয়াদবী করে। পরে সেখানকার মুসলিমরা এটা শুনে ক্ষুব্ধ হয়, পরে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারী সেই হাকিকত রায়কে গ্রেফতার করে লাহোরের আদালতে প্রেরণ করে। পরে হাকিকত রায়সহ অন্যান্য আসামীদেরকে লাহোরের কোর্টে কাঠগড়ায় এনে মৃত্যুদন্ডের আদেশ শুনিয়ে দেওয়া হয়।পরে রাসূল সাঃ এর কটুক্তিকারী হাকিকত রায়সহ সেইসব আসামীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়৷সেই দিনটাও ছিল বিধর্মীদের বসন্ত পঞ্চমীর দিন।তৎকালীন সময়ে আসামী হাকিকত রায়ের মৃত্যুদন্ডের পরে বিধর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া আসে৷ পরে তাদের এক ধর্মগুরু সেই আসামীর মৃত্যুর দিনকে স্মরণের জন্য বসন্ত মেলার প্রচলন শুরু করে। অর্থাৎ এই প্রেক্ষাপট শুনলেই বুঝা যায় যে এই বসন্ত মেলা এটা মহানবী সাঃ এর কটুক্তিকারী একজন অপরাধীর স্মরণে উৎসব যা একজন প্রকৃত মুসলিম/মুসলমান কখনোই উদযাপন করতে পারে না৷(তথ্যসূত্র- মাওলানা ইলিয়াস আত্তার কাদেরীর বসন্ত মেলা বইয়ের বাংলা অনুবাদ,মাকতাবাতুল মদীনা দাওয়াতে ইসলামী, উইকিপিডিয়া,আলজাজিরা ও পাকিস্তানের কিছু গণমাধ্যমে সেদেশের বুদ্ধিজীবী ওরিয়া মকবুল জানের বক্তব্য )
পাকিস্তানে বসন্ত মেলা এই দিবস উৎসব অনেকবার নিষিদ্ধ হয়েছিল৷সেদেশে এই উৎসবের মধ্যে অনেক দূর্ঘটনার সংবাদও শোনা গিয়েছিল (তথ্যসূত্র-দি সেন্ট্রাম মিডিয়া The Centrum media)।সবশেষ গত ২০২১ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সেখানকার প্রশাসন এই বসন্ত মেলায় নিষেধাজ্ঞা দেয়(তথ্যসূত্র-পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন নিউজ)
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের অন্যতম সংবাদ মাধ্যম,টেলিভিশন চ্যানেল এক্সপ্রেস নিউজের একটা টক-শো অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উপদেষ্টা ও পাকিস্তান উলামা কাউন্সিল নামে সেদেশের একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাওলানা তাহির আশরাফী এই বসন্ত মেলার দূর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন "এটা বলা সহজ যে ঘুড়ির সুতায় একজন সন্তানের গলা কেটে গেলে আহত হলে এর দায় কার হবে?? " (তথ্য সূত্র -দি সেন্ট্রাম মিডিয়া) ।
আমাদের বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে ও অনেক শহরে ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। কিন্তু গ্রাম বাংলায় মূলত বাংলা মাস মাঘের শেষদিকে ও ফালগুন-চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। আবার কোনো কোনো সময়ে গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমেও গ্রামেগঞ্জে ঘুড়ি উড়তে দেখা যায় এটা ঠিক৷অনেকের মতে, শীত মৌসুমে বিশেষত পৌষের শেষদিনগুলোতে ও মাঘমাসের প্রথম কয়েকদিন ঘুড়ি উড়ানো এটা এসেছে মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে হিন্দু,বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে৷ কেননা এই দিনগুলিকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি উড়ানো তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের অন্তর্গত৷তাই যেকারণে অনেক মুসলিমরা ভারতের মতো বাংলাদেশেও জানুয়ারির ১২-১৫ তারিখে ঘুড়ি উড়াতে নিরুৎসাহিত করে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আমাদের বাংলাদেশের অনেক প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সংবাদগুলোতে দেখলেই বুঝা যায় এই সাকরাইনে মূলত দিনের বেলা ঘুড়ি উড়ায় এবং সন্ধ্যা ও রাতে আতশবাজি ফোটানো আর ফানুস উড়ানো হয়। তবে এই কথিত সাকরাইনে অনেক উল্টাপাল্টা কর্মকান্ডও হয়।পুরান ঢাকার হিন্দু প্রভাবিত এলাকা যেমন শাখারীবাজার,তাতীবাজার বা এজাতীয় এলাকায় খুব ধূমধাম করে এই সাকরাইন পালিত হয়। বিশেষ করে সাকরাইনের আগের দিন অর্থাৎ ১৩জানুয়ারি রাত ৯টার পর থেকে এলাকার বিল্ডিংগুলোতে গান বাজনা ও ডিজে বাজানোর প্রস্তুতি চলে। ১৪তারিখ অর্থাৎ সাকরাইনের দিন সকাল ৮টার পর থেকেই উচ্চৈশব্দে গান বাজায়৷ আস্তে আস্তে মোট ৩-৪টি বিল্ডিং থেকে ডেক্সেট ও ডিজেবক্সের আওয়াজ চলতে থাকে। সৃষ্টি হয় কোলহলের পরিবেশ। যদিও যোহর, আসর,মাগরিব ও এশার আজানের ১মিনিট আগে থেকে আযান শেষ হওয়া পর্যন্ত ডেক্সেটের গান বাজনা বন্ধ থাকে। আযান শেষ হওয়ার ২মিনিট পর থেকে ফের চলে গানবাদ্য বাজনা সন্ধ্যা হওয়ার ৫মিনিট আগে থেকেই চলে আতশবাজি পটকা ফুটানো।
এই কথিত সাকরাইনের দিন যারা ডেক্সেটে গান বাজায় তারা অনেক সময় অশালীন টাইপের গানও বাজায়। এই সাকরাইনে মাস্তির নামে অনেকে মদজাতীয় জিনিস পান করে। যারা সাকরাইনে উপরোক্ত এসব কাজ করে তাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৫-৩৪ বছর। এসবের প্রভাবে মূলত পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় শব্দদূষণের পরিস্থিতি বিরাজ করে। স্কুল,মাদ্রাসা ও কলেজের ছাত্রদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ও বিঘ্ন ঘটে। স্কুল,মাদ্রাসা ও কলেজসমূহে ক্লাস করার সময়ও এই ভয়ংকর শব্দদূষণের প্রভাব কিছুটা থাকে। আসলে এই সাকরাইনের দিনে ভয়ংকর শব্দদূষণ ও তার প্রভাব সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশের অন্যতম
১৪ জানুয়ারির আগের দিন রাতেই পুরান ঢাকার ভবন মালিকদের নির্দেশনা ইচ্ছা উপেক্ষা করে বাড়িঘর ভবনের ছাদ দখল করে একদল ছেলেমেয়ে যুবকরা,এমনকি জানুয়ারির ১৩-১৫ তারিখ পুরান ঢাকার অনেক অঞ্চলে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ দেখা যায়। শুক্রবার ছাড়া অন্য দিনে সাকরাইন হলেই স্কুল মাদ্রাসা কলেজ খোলা থাকলে কী অবস্থা তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি। সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশের বড় বড় সংবাদপত্রসমূহ ও অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালে জানুয়ারীর ১৪ ও ১৫ তারিখের সংবাদ গুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে ইদানীং সাকরাইনে অনেকে ঘুড়ি উড়ানোর চেয়ে ডিজেবক্স গান বাজনা নাচানাচি ও আতশবাজির দিকে ঝুকেছে ।যা খুবই দুঃখজনক।
সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি থেকে জানুয়ারির ১৪ ও ১৫ তারিখে আতশবাজি ও ফানুসে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া স্বত্বেও পুরান ঢাকার অনেক জায়গায় এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আতশবাজি করতে দেখা গিয়েছে। ত কয়েক বছরে পুরান ঢাকায় সাকরাইন দিবস উৎসব এভাবেই বদলে গেছে । হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনের জন্য
বিড়ম্বনাময়। এমনকি অনেক ভবন উচ্চ ছাদ থেকে পরে মৃত্যুরও ঘটনা ঘটেছে ।ছাঁদ দখলের জন্য আজব অনুরোধ আসে।পুরান ঢাকার শিক্ষা-সংস্কৃতি-পরিবেশ কিংবা ঐশ্বর্য মন্ডিত স্থাপনা ভবনগুলোর উন্নয়ন নিয়ে তেমন কোন প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও ,মানুষকে কষ্ট দেয়া এই বিতর্কিত উৎসবের সংবাদ প্রচারে মিডিয়াতে চলে কাড়াকাড়ি,চ্যানেলে চ্যানেলে উৎসবের বেসাতি-সাক্ষাত্কারের ছড়াছড়ি!সাকরাইন উপলক্ষে লক্ষলক্ষ টাকা অপব্যয় করে আতশবাজি করা হয়।অথচ এসব টাকা অপব্যয় না করে গরীবদের কল্যানের জন্য দেওয়া যেত।ফুর্তির নামে নির্লজ্জতায় ডুবে যায় সমাজের একটা অংশ। সাকরাইনকে অবলম্বন করে একদল কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এই দিনগুলোতে,পুরান ঢাকাকে জিম্মি করার চেষ্টা চলে।কথায় আছে, লজ্জা উঠে গেলে কোন কিছু করতেই বাধা থাকে না। নগ্নতা,সাংস্কৃতিক আগ্রাসন,বেহায়াপনা আর উম্মাদনার জ্বলন্ত স্বাক্ষী হয়ে থাকে দিনটি।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলেছেন "অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই', আবার কুরআনের অন্যত্র এসেছে " তোমরা অপব্যয় করো না "(সুরা বনী ইসরাইল আয়াত ১৭)। সাকরাইন ও বসন্ত মেলার নামে উপরোক্ত কর্মকান্ডগুলো দেখলে বুঝা যায় সেখানে অনেক অপচয় ও অপব্যয় হচ্ছে।হাদিসে এসেছে,রাসূলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেন " যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল"(তাবারানী,মুজামুল আওসাত)। অনেক আলেম উলামাগণ ঘুড়ি উড়াতে নিরুৎসাহিত করেছেন, পাশাপাশি সাকরাইনকেন্দ্রিক উপরোক্ত আপত্তিকর কর্মকান্ডের জন্য ঘুড়ি উড়ানোকে নিরুৎসাহিত করাটা অবশ্যই যৌক্তিক।বিশেষ করে সুনানে আবু দাউদ এর - ৪৯৪০ নং হাদিসের আলোকে কবুতরের পিছনে খেলার জন্য দৌড়ানো আর ঘুড়ির পিছনে দৌড়ানোকে একই জিনিস মনে করে অনেকে ঘুড়ি উড়ানোকে নিরুৎসাহিত করেন।উপমহাদেশের অন্যতম আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী এই জন্যই ঘুড়ি উড়ানোকে নিরুৎসাহিত করে নাজায়েজ বলেছেন৷আলা হযরত খ্যাত মাওলানা আহমদ রেযা খান বেরলভীর তার অন্যতম গ্রন্থ ফতোয়ায়ে রযভীয়ার ২৪ তম খন্ডের ৬৬০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে : "ঘুড়ি কুঁড়ানো হারাম । হ্যাঁ , স্বয়ং এসে যদি কারো সামনে পড়ে , তবে সেটি ছিঁড়ে ফেলবে । আর মালিক সম্পর্কে জানা না থাকলে তবে দড়িগুলো কোন মিসকিনকে দিয়ে দিবে , সে যেন কোন জায়েয কাজে ব্যবহার করতে পারে । নিজে মিসকিন হলে নিজে ব্যবহার করতে পারবে । অতঃপর যদি জানা যায় যে , দড়িগুলো অমুক মুসলমানের , আর সে যদি সেই মিসকিনটিকে দান করা কিংবা ব্যবহার করাতে সন্তুষ্ট না থাকে , তাহলে তাকে দিয়ে দিবে । আর ঘুড়ির জন্য মূলত : কোন বদলা নেই ।" জনপ্রিয় ইসলামী সংগঠন দাওয়াতে ইসলামীর দারুল ইফতা আহলে সুন্নাত বা দাওয়াতে ইসলামীর ফতোয়া বিভাগে ফতোয়া এসেছে যে "ঘুড়ি উড়ানো থেকে বিরত থাকা উচিৎ "।
র্যাগ ডে (RAG Day) এটা সর্বপ্রথম শুরু হয় ১৯২৬সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়।এশিয়ার মধ্যে ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগ ডে এটি ব্যাপকভাবে শুরু হয়, পরে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এই র্যাগ ডে অনুষ্ঠান আয়োজন শুরু হয়।বাংলাদেশে ৪-৫বছর আগে দেখা যেত যে র্যাগ ডে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়ে থাকত,এখন বর্তমানে এটা স্কুল কলেজেও ঢুকেছে। ইন্টারনেটে আমরা দেখি র্যাগ ডে শব্দটির অনেক অর্থ পাওয়া যায়।
র্যাগ হল-ইন্টারনেট ঘেঁটে যতদূর জানা যায়, এটি সম্ভবত গ্রীক কালচার। সপ্তম-অষ্টম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট নিয়ে আসার জন্য র্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। র্যাগ শব্দটি মূলত ইংরেজি র্যাগিং থেকেই এসেছে। আর ইউরোপে প্রচলন ঘটে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি। ১৮২৮-১৮৪৫ সালের দিকে র্যাগ সপ্তাহের প্রচলন ঘটে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশেষ করে ছাত্র সংস্থা- পাই, আলফা, বিটা, কাপ্পা এই সপ্তাহটির প্রচলন ঘটাতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল।র্যাগ ডের আরেকটা অর্থ হল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হৈ-হুল্লোড়ের দিন। তবে আরো মজার ব্যাপার, ইউরোপ-আমেরিকায় এর যাত্রা হলেও বর্তমানে আমাদের এশিয়াতেই এর ব্যবহার সর্বাধিক।বাংলাদেশের অন্যতম সংবাদপত্র দৈনিক যুগান্তর ও বিবিসি বাংলার মতে র্যাগ ডে হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে একটি বিশেষ দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষার্থীরা এ দিনে নানা আয়োজন করে।
র্যাগ-ডে স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষার্থীরা সেদিন একসাথে ছবি তোলে, কেউ র্যালি করে, কেউ ব্যান্ড পার্টি এনে বাজায় কিংবা কেউ রং মাখামাখি করে,কেউ ডিজেবক্স বাজায় ও নাচানাচি করে।স্কুলে দশম শ্রেনীতে এসএসসির আগে ও কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে এইচএসসির আগে র্যাগ ডে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগ ডে অনুষ্ঠান হয়।দেড় বছর আগে দেখা যেত স্কুল কলেজে অষ্টম,দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির মডেল টেস্ট পরীক্ষার আগে র্যাগ ডে হত ।আগে এটাকে বলা হত সমাপনী ক্লাস।২০১৬ সালের আগে স্কুল ও কলেজে র্যাগ ডে নামে কোনো অনুষ্ঠান হত না৷বর্তমানে র্যাগ ডে তে অনেক স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় সাদা গেঞ্জি টিশার্ট পরিধান করে শিক্ষার্থীরা।সেই টিশার্টের গায়ে মার্কার কলম দিয়ে অনেক শব্দ লেখে।এমনকি সেখানে অনেক অশালীন শব্দ লিখতেও দেখা যায়।স্কুলে যেদিন দশম শ্রেণীর র্যাগ ডে হয় সেদিন অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস শ্রেণি পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটে এটাই স্বাভাবিক।র্যাগ ডে মূলত শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে করে।সেখানে দুয়েকজন শিক্ষার্থীদেরকে দাওয়াত দিয়ে বক্তৃতা দেয় তারপর কেক কাটে,মধ্যাহ্নভোজ হয় এবং নাচ গান বাজনা মিউজিক চলে।স্কুল কলেজগুলোতে র্যাগ ডে কে কেন্দ্র করে অনেক বিধিনিষেধ দেওয়া হয়।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধায় অনেক স্কুল কলেজে র্যাগ ডে তে ডিজেবক্স এ নিষেধাজ্ঞা দেয় ও সীমিত ভলিউমে ডেক্সেট বা সাউন্ডবক্স বাজানোর অনুমতি দেয়।
ইদানীং র্যাগ ডে কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আপত্তিকর অভিযোগ শোনা যায়।যা খুবই দুঃখজনক।সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে স্কুল ও কলেজে বিদায়ী অনুষ্ঠান এবং র্যাগ ডে নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে।কিন্তু দুটোই পৃথক অনুষ্ঠান।কয়েকবছর আগে দেখা যেত এস এস সি ও এইচএসসি পরীক্ষার আগে বাংলাদেশের সব স্কুল কলেজে বিদায়ী অনুষ্ঠান ও দোয়া মাহফিল হত।অনেক কলেজসমূহতে দেখা যায় যেদিন বিদায়ী অনুষ্ঠান হয় সেখানে কুরআন তিলাওয়াত,হামদ নাত দেশাত্মবোধক গান গজল,শিক্ষকদের বক্তৃতা এবং দোয়া মোনাজাত হয়,ছাত্ররা শিক্ষকদের কাছে দোয়া চায়। কিন্তু এই বিদায়ী অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার ২০-৩০মিনিট পরে কিছু ছাত্ররা কলেজের কতিপয় বড়ভাইদের সাহায্যে র্যাগ ডে করে থাকে,সেখানে ডেক্সেটে গান মিউজিক বাজায়,নাচানাচি চলে ও রং ছিটায়।আবার অনেক কলেজে র্যাগ ডে ও বিদায়ী সংবর্ধনা পৃথক দিনে হয়।
র্যাগ ডে কে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের অসংখ্য স্কুল কলেজে দেখা গিয়েছে যে সেখানে ছেলে মেয়ের মাঝে কোন ধরনের পার্থক্য না করে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি গানে নাচানাচি, একে অপরকে রং মাখিয়ে দেওয়া, অন্যের কাপরে অশালীন বাক্য লিখে দেওয়া-সহ বেশকিছু ঘটনা চোখে পড়েছে যা দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিরোধী। তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাও ছিল ব্যাপক। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির মত অপ্রীতিকর ঘটনাও সামনে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগ ডে তে অনেক ছাত্ররা জমায়েত হয়ে ফ্ল্যাশ মব নাচানাচি করে।সাউন্ডবক্সে বিভিন্ন গান মিউজিক বাজায়।আর এর তালে তালে অনেক ছাত্রছাত্রীরা একত্রে নাচানাচি করে ও হাত তালি দেয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্রদের বিঘ্ন ঘটে। অনেক স্কুলে দেখা যায় যেখানে বিদায়ী সংবর্ধনা ও দোয়া মাহফিল হবে সেই মঞ্চেই অনুষ্ঠান শুরুর আধাঘন্টা আগে অনেক ছাত্ররা মিউজিক বাজিয়ে নাচানাচি করে।
তবে ইদানীং প্রচলিত র্যাগ ডের কারণে স্কুল কলেজের বিদায়ী অনুষ্ঠান বিলীন হতে শোনা যাচ্ছে যা খুবই দুঃখজনক।গত দুই তিন বছর যাবত দেখা গেছে যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি স্কুল কলেজে রবিউল আউয়াল মাসে মিলাদুন্নবী সাঃ কিংবা সীরাতুন্নবী সাঃ স্মরণে কুরআন তিলাওয়াত, হামদ নাত,আলোচনা বয়ান ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠান না হলেও প্রতিবছর র্যাগ ডের মত অনুষ্ঠান হয়। ইদানীং স্কুল পর্যায়ে অষ্টম শ্রেনীতেও এই র্যাগ ডে ঢুকেছে।সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও তার আশপাশের জেলা শহরের অধিকাংশ স্কুলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ ডে এর নমুনায় অনেক শিক্ষার্থীরা হৈহুল্লোড় করেছে। অবাক হয়েছি এটা শুনে যে, মেয়ে শিক্ষার্থীরা এখানে যৌন হয়রানির শিকারও হয়েছে।হিন্দুদের হোলি উৎসবের মতো করে সেখানে রং ছিটানো হয় (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।এমনকি অনেক স্কুল কলেজে শ্রেণিকক্ষের টেবিল অপমান করতেও দেখা যায়। এসব কি আদৌ আমাদের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ??এসব কি আমাদের বাংলাদেশী সংস্কৃতির অংশ?? কখনোই না।র্যাগ ডের নামে যেসব উল্টাপাল্টা কর্মকান্ড হয় এগুলোর সাথে ইসলামী ভাবধারা ও বাঙালি বাংলাদেশী সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায় না। মূলত র্যাগ ডের নামে এসব অপসংস্কৃতির মাধ্যমে ইসলামী ও বাঙালি বাংলাদেশী সংস্কৃতি বিলীন করার ভয়ংকর অপচেষ্টা চলছে৷ শিক্ষাঙ্গনে এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকেই সমালোচনা করেছেন, কেউ বলেছেন, এক সময় কত সুন্দর করে স্কুলের শেষ দিনটি পালন করতাম। স্যারের দোয়া নিতাম, শিক্ষাঙ্গনে একসাথে দীর্ঘ সময় কাটানো বন্ধুরা একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে চোখের পানি চলে আসতো। সামনে পরীক্ষার কথা চিন্তা করে সবাই দোয়া-মুনাজাতে লিপ্ত থাকতো। বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন হতো। অথচ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও সংস্কৃতি!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড এম কে শাহনেওয়াজ বলেন "র্যাগ ডে" নামের এ উৎসব ছিল নিটোন আনন্দের সারা উৎসব শেষে সন্ধ্যায় বিদায়ী শিক্ষার্থীদের সৌজন্যে উপাচার্যের পক্ষ থেকে একটি ডিনারের আয়োজন করা হতো ডিনারের শুরুতেউপাচার্য মহোদয় পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দিতেন । জীবনে চলার পথের যেন কিছু মূল্যবান পাথেয় দিতেন তিনি । তবে বর্তমানের অবস্থা ভয়াবহ ' র্যাগ - ডে' উৎসবের আড়ালে সাদা টিশার্ট পরিহিত তরুণ - তরুণীরা একে অপরের টিশার্টে , শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় লিখে দিচ্ছে অশ্লীল শব্দ ! একে অপরের গায়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে বিভিন্ন কালারের রং । ডিজে গান ও বাদ্য বাজিয়ে কাপিয়ে তুলছে শিক্ষাঙ্গনের আকাশ - বাতাস । এদের অবস্থা দেখলে বুঝা যায় যে , তাদের জ্ঞানের পরিধি কতটুকু । (লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ)
সম্প্রতি র্যাগ ডে পালন করতে না দেওয়ায় গত ১৩ নভেম্বর শনিবার নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ সরকারি কলেজে বহিরাগতদের সাথে বাকবিতন্ডা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে । এইচএসসি দ্বিতীয়বর্ষের বিদায় দিনে র্যাগ ডে পালন করতে চাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা ।কিন্তু সেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে র্যাগ ডে পালনে নিষেধ থাকা স্বত্বেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার ভয়ে এতে বাধা দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। ফলে সেখানে হামলাকারী একদল শিক্ষার্থীরা কলেজের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষ ভাঙচুর করে ।সেখানে কুপিয়ে শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন টেবিল , হোয়াইটবোর্ড , সিলিং ফ্যান ও সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয় । এ সময় হামলাকারী শিক্ষার্থীরা অশালীন ভাষায় শিক্ষকদের গালাগাল করার খবরও বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ছেপেছে।
এসব দেখে কেউ আবার বলেছেন, নৈতিকতা ও সংস্কৃতি যখন আধুনিকতার নামে বন্দী করা হয়েছে, তখন অপসংস্কৃতির ভয়ানক অপব্যবহার গ্রাস করে নিচ্ছে শিশু-কিশোর তরুণ-যুবকদের। একসময় এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা বড়দের দোয়া এবং ধর্ম পালন করে ভালো রেজাল্টের চেষ্টা করত; আজ সেখানে গান বাজনা নাচ নষ্টামির মাধ্যমে উল্লাস করতে দেখা যায় র্যাগ-ডে নামক অনুষ্ঠানে।এবিষয়ে সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিরোধী সবকিছু পরিহার করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের এমন কিছু কখনোই করা উচিত নয় যা অন্যের চোখে নিজের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বাবা-মাকে পরবর্তীতে এর কারণে অপমানবোধ করতে হয়।
তিনি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার, অন্যের থেকে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার একধরণের প্রবণতা দেখা যায়; এই প্রবণতা এক ধরণের আচরণগত আসক্তি’ বলছেন তিনি।
তিনি বলছেন, মাদক গ্রহণ করাই শুধু আসক্তি নয়, তারুণদের সাথে সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে ফুঠিয়ে তোলার যেই প্রবণতা দেখা যায়; এই প্রবণতা এক ধরণের আচরণগত আসক্তি’ বলছেন তিনি।
তিনি বলছেন, মাদক গ্রহণ করাই শুধু আসক্তি নয়, তারুণদের সাথে সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে ফুঠিয়ে তোলার যেই প্রবণতা এটিও এক ধরণের আচরণগত আসক্তি। এসব পরিহার করা উচিত বলে মতামত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদের।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির প্রফেসর শাহেদ হারুন বলেন যে "শিক্ষাঙ্গনে বিজাতীয় সংস্কৃতি বন্ধে বিদ্যালয় প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের পদক্ষেপই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে"।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসনের কারণেই বুয়েট এবং বেশকিছু বিদ্যালয়ে এসব বন্ধ হয়েছে’।
‘তারুণ্য উন্মাদনা ও পাগলামিরই অংশ’ এই উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেছেন; "তরুণদের মাঝে উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা থাকবেই, তবে এসব নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। চাই তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হোক বা স্কুল প্রশাসন। তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করলেই তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
‘শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার প্রতি আগ্রহী করতে হবে। তাদের মাঝে জাতি সত্ত্বা, সংস্কৃতিবোধ ও সচেতনতা তৈরি করতে হবে’- বলেন তিনি।
‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধি-নিষেধ আরোপের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের মাঝেও তা মানার মানসিকতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সচেতনতা মূলক সেমিনার, বিতর্ক অনুষ্ঠানও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে"সংযোগ করেন এই শিক্ষাবিদ।
তার ভাষ্য, ‘র্যাগ- ডে’র নামে যা কিছু ঘটছে এসব অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে ঘটে থাকে, তাই এসবের জন্য শিক্ষার্থীদের যথাযথ জবাবদিহীতার আওতায় আনার মাধ্যমেও তা বন্ধ হতে পারে’।বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যতম একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল জহুরা বেগম বলেন, এটা একটা অপসংস্কৃতি। যে প্রতিষ্ঠানই হোক এটি অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করব কোন প্রতিষ্ঠান এগুলো করছে, তারা যেন এগুলোকে বের করে আনেন এবং সেসব শিক্ষক যারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
এদিকে রাজধানীর মাইলস্টোন কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী এবিষয়ে বলেছেন, ‘কোন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনোই চান না শিক্ষার্থীরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ুন’।
তিনি বলেছেন, ‘তরুণদের বয়সটাই এমন যে তাদের গভীরভাবে কোন কিছু ভাবার সুযোগ থাকে না । বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাবে তরুণদের সামনে রঙ্গিন আলো ঝলমলে দুনিয়া হিসেবে যা উপস্থাপন করা হচ্ছে তারা সেটাকেই গ্রহণ করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের তরুণদের নিজস্ব সংস্কৃতি, এতিহ্য, শেকড় ও দ্বীন ধর্ম আগলে ধরার গুরুত্ব বোঝানো উচিত’।
‘পাশ্চাত্যের যা কিছু ভালো তা আমরা গ্রহণ করব; কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও শালীনতা বিরোধী কিছু থাকলে তা অবশ্যই পরিত্যাগ করা কর্তব্য’ বলে মনে করেন তিনি।
র্যাগ ডের নামে ইদানীং যেসব কর্মকান্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয় সেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতেও নিন্দনীয়। কুরআন সুন্নাহর আলোকে সর্বপ্রকারের অশ্লীলতা ও বেহায়াপানা বর্জনীয় যেসব অনুষ্ঠানে এসব হয় সেগুলো থেকে বিরত থাকারও নির্দেশনা এসেছে । এজন্য অনেক দ্বীনদার মুসলিম শিক্ষার্থীরা র্যাগ ডে কে এড়িয়ে চলে৷
পরিশেষে বলতে চাই একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে বছরের প্রতিটি দিনই আল্লাহ তায়ালার কাছে সমান।তাই যারা বছরে একদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগ ডের নামে হৈ-হুল্লোড় করে তাদেরও বুঝা উচিৎ যেদিন তারা এসব করছে সেদিনটাও অন্যান্য দিনের মতোই আল্লাহর নিকট সমান।র্যাগ ডে ও সাকরাইনের নামে চেচামেচি শব্দদূষণ ও বেহায়াপনা থেকে দূরে সরে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে অন্যথায় কিয়ামতের দিন এসবের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে৷আল্লাহ তাআলা সূরা লুকমানে আখেরাত-প্রত্যাশী মুমিনদের প্রশংসা করার পর দুনিয়া-প্রত্যাশীদের ব্যাপারে বলছেন,"আর একশ্রেণীর লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত খেল-তামাশার বস্তু ক্রয় করে বান্দাকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার জন্য।"-সূরা লুকমান : ৬।কুরআন মজীদের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজী পেশ করলে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে বললেন,"তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস পদস্খলিত কর।"-সূরা ইসরা : ৬৪
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তাই ইবলিসের আওয়াজ।
হাদিসে এসেছে আমর ইবনু শু‘আয়ব তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর পিতামহ হতে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্য করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
(জামে আত তিরমিযী হাদিস নং ২৬৯৫, আল জামি‘উস্ সগীর ৯৫৬৫, সহীহুল জামি‘ ৫৪৩৪, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৭৩৮০, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭২৩।)
,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ "
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত (হয়ে যাবে)।
(হাদিস টির হুকুম হাসান : আবূ দাঊদ ৪০৩১, আল জামি‘উস্ সগীর ১১০৯৪, সহীহুল জামি‘ ৬১৪৯)
গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহঃ বলেন,"যদি তুমি যুদ্ধ ছাড়া কোন জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাও, তবে ঐ জাতির মাঝে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ছড়িয়ে দাও।"
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র অশ্লীলতা,অপসংস্কৃতি বর্জনের তৌফিক দান করুন
(আমিন)।
Comments
Post a Comment