ছোটবেলায় যখন আমার বয়স ৬ থেকে ৮/৯ বছর (তখন ২০০৮-২০১২ সাল) ছিল তখন আমার বাসায় টেলিভিশন বা টিভিতে দিনে বা রাতে কিছু টিভি চ্যানেলে একধরনের গান সংগীত গীতিকবিতা সম্প্রচার হতে দেখতাম। অনেক বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলে,পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল পিটিভিসহ সেদেশের অনেক টিভি চ্যানেলে বিশেষত জনপ্রিয় ধর্মীয় টিভি চ্যানেল ARY QTV তে একদল মুসলমানরা ঢোল,দফ,হারমোনিয়াম জাতীয় বাদ্য সহকারে উর্দু,হিন্দি,পাঞ্জাবী,ফার্সি এমনকি আরবীতেও ইসলাম ধর্মের পক্ষে,আল্লাহ ও তার রাসূল সাঃ এর প্রশংসায়,ইসলামের প্রথম চার খলিফা ও নবী পরিবার বা আহলেবায়তের প্রশংসায়,হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ,জালাল উদ্দিন রুমী,খাজা মুইনুদ্দিন চিশতী রহঃ,নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহঃ সহ আউলিয়ায়ে কিরাম বা আল্লাহর ওলীদের প্রশংসায় কিছু গজল গীতিকবিতা গাইছে ।তখন আস্তে আস্তে এই ৬-৯ বছর বয়সের মধ্যে আমার বাবা মা ও পরিবারের অনেক আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি এটাকে কাওয়ালি বলে। জ্বি আমি এই কাওয়ালীর প্রসঙ্গেই বলছি।একে আবার "সামা " বা মাহফিলে সেমাও বলে।যখন স্কুল জীবনে ৫ম-৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম তখন জানতে পেরেছি এটা সুফি সংগীত সাহিত্যের অন্যতম অংশ৷ ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকা,মোহাম্মদপুরের উর্দুভাষী বিহারীদের জেনেভা ক্যাম্প ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা,মিরপুরের বিহারি অধ্যুষিত এলাকাসমূহতে এই কাওয়ালী চলে ,এই কাওয়ালীই ঢাকা ও চট্টগ্রামের একটা অন্যতম ঐতিহ্য হিসেবে প্রমাণিত।বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অনেক অঞ্চলে সাহিত্য সংস্কৃতির জনপ্রিয় একটা শাখা হল এই কাওয়ালী।চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি গান কবিতার সাথে কাওয়ালীর অনেক মিল আছে৷সম্প্রতি গত ১২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রথমবারের মত একটা কাওয়ালী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সিলসিলা ব্যান্ডের উদ্যোগে হয়েছিল৷ সেখানে হঠাৎ দুর্বৃত্তদের হামলার পর থেকেই এই কাওয়ালী নিয়ে অনেক আলোচনা শোনা যাচ্ছে। অনেকেে
নেকে এই কাওয়ালিকে হামদ নাত নাশিদের মতোই একটা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক গীতিকবিতা মনে করেন। তবে হামদ নাত নাশিদের সাথে প্রচলিত সামা কাওয়ালির বেশ পার্থক্য রয়েছে৷ মূলত কখন থেকে ইসলামী গজল নাশিদ হামদ নাত কাসিদার শুরু হয়েছে এটা সঠিকভাবে বলা যায় না। রাসূল সাঃ এর সময়কালে সাহাবী হযরত হাসসান বিন সাবিত রাঃ একজন অন্যতম কবি ছিলেন৷ তিনি ইসলাম গ্রহণের পরে আল্লাহ ও তার রাসূল সাঃ এর সম্মান ভালোবাসায় কবিতা লিখতেন। তাকে এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাঃ নিজেই উৎসাহ দিতেন।
এই সামা,কাওয়ালী ও সুফি গীতিকবিতার উৎপত্তি নিয়ে অনেক কথাবার্তা শোনা যায়।
কাওয়ালি যারা পরিবেশন করেন বাংলাতে তাদের কাওয়াল বলা হয়। গানের বিভিন্ন ধাপে কাওয়ালগণ স্রষ্টার প্রতি ভক্তি, প্রশংসা ইত্যাদি বর্ণনা করে থাকেন। কাওয়ালের দলে একজন মূলত গান করেন। দলের অন্যরা ধুয়া (তাল দেয়া) ধরেন। উপমহাদেশের এই সংগীতের বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসের আলোকে জানা যায় মূলত অষ্টম শতাব্দীর সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত পারস্যের অনেক জায়গায় সুফিপন্থীদের একটা আসর বসতো,সেখানে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক গীত কবিতা গাওয়া পাঠ করা হত৷ সেখানে ঘুর্নায়মান সুফি নৃত্যও হত। ঐতিহাসিকদের মতে, ৯০০ খ্রিস্টাব্দে সুফি মতবাদ ও দর্শন বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। কাওয়ালী শব্দটা এসেছে কওল থেকে৷ কওল-এর আভিধানিক অর্থ বলা। মূলত, এখানে রাসুল (সাঃ) সম্পর্কিত কথাবার্তাকেই নির্দেশ করা হয়েছে। এদিক থেকে কাওয়ালের অর্থ দাঁড়ায়, যিনি কথাগুলো (রাসুল স. সম্পর্কিত) বারবার উচ্চারণ করেন।খিলাফতে উসমানীয়ার সময়ে তুরস্কে সুফিদের বিভিন্ন হালকাহ হতো। সেখানে ঘুর্নায়মান নৃত্য ও দফসহ আরবী ফারসি ও তুর্কিশ ভাষায় বিভিন্ন কাসিদা গজল বিশেষত আব্দুর রহমান জামী,মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী,জালাল উদ্দিন রুমী উনাদের গীতিকবিতা কাসিদা গাওয়া হত।আবার কোনো কোনো সময়ে বাঁশিও ব্যবহৃত হত। ভারতীয় উপমহাদেশে হিজরী ৭ম শতকে হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) ভারতে দেখেন সেখানকার বিধর্মীরা খুব সংগীতপ্রিয়।এটা দেখে তিনি ইসলামী ভাবধারা অনুসারে সামা মাহফিল শুরু করেন। এই সামা মাহফিলের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করতেন৷ তবে হ্যা এটা সত্য তখনকার আমলের সামাতে কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না৷ হযরতের বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন কুতুবুদ্দদিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) এবং দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়া (র.) প্রমুখ। অনেক বই পুস্তকে বর্ণিত আছে যে, কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী (র.) সামা কাওয়ালীতে টানা কয়েকদিন মশগুল থাকতেন। এরপর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (র.) দরবারেও কাওয়ালির আসর বসতো। নিজামুদ্দীন আউলিয়ার (র.) প্রিয় শিষ্য হযরত আমির খসরু (র.) কাওয়ালি গানকে রীতিসিদ্ধ করেন। অর্থাৎ, কাওয়ালিকে একটি নিয়মের মধ্যে এনে প্রচার করেন তিনি। এজন্য তাকে কাওয়ালীর জনক বলা হয়। সুফিবাদ চর্চার পাশাপাশি তিনি একাধারে কবি, গায়ক এবং একজন যোদ্ধাও ছিলেন। তার উপাধি ছিল 'তুত-ই-হিন্দ' বা হিন্দের তোতা পাখি।
একাদশ-দ্বাদশ শতকে সুফিরা উপমহাদেশের মুলতান এবং পাঞ্জাবে আসেন। ক্রমেই তারা বিহার, বাংলা এবং দক্ষিণে তাদের বসবাস গড়ে তোলেন। তাদের মাধ্যমেই পারস্যের কবিতাগুলো চিশতীয়া তরিকার সুফি হযরত আমির খসরু (রহ.) এর কাছে চলে আসে। আমির খসরু হিন্দি, পূরবী এবং ফারসি ভাষায় তার কাওয়ালি গানগুলো রচনা করেছিলেন।অনেকে বলে আমির খসরু নাকি সামা কাওয়ালীতে সংস্কার করতে গিয়ে বাদ্যযন্ত্র ঢোল তবলা বাঁশি হারমোনিয়াম সারিন্দা রাবাব সংযোজন করেছেন।তাদের কথাটা কতটুকু সঠিক বা ভুল আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। আবার অনেকেই বলছেন আমির খসরু কখনোই সামা কাওয়ালিতে বাদ্যযন্ত্র প্রচলন শুরু করেন নাই।
উপমহাদেশে সামা কাওয়ালি এটা কাদেরীয়া(কাদেরীয়া তরিকায় অনেকে সামা কাওয়ালি করে অনেকে করে না) ও চিশতীয়া নিজামীয়া তরিকার মধ্যে দেখা যায়।অনেক আলেম উলামা মাশায়েখরা বলেছেন যারা সামা কাওয়ালিতে প্রচলিত বাদ্য-বাজনা অনুপ্রবেশ করিয়েছেন তারা বিদআতী ও পথভ্রস্ট। বাংলায় কাওয়ালিকে কে বা কারা সূচনা করেছেন তার সম্পর্কে সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়না। এদেশে সুফিগণ আসার পরে তারাও কাওয়ালি করতেন। ঐতিহাসিক ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে, চিশতীয়া তরিকার সাধকেরা সামা গানের তালে দাঁড়িয়ে নৃত্য করতেন। একপর্যায়ে তারা ভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তখন তাকে চরম পর্যায় বলে গণ্য করা হতো। সুফী মতানুসারে এ অবস্থার নাম 'ফানা হওয়া'। কাওয়ালির মাধ্যমে খোদার প্রেমে মগ্ন হবার কথা সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতীও বলতেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় বাংলাতেও সুফি সাধকদের দরগা থেকেই কাওয়ালির প্রসার হয়।
মধ্যযুগে ও ব্রিটিশ আমলে ঢাকার নবাবদের বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিলো কাসিদা ও কাওয়ালি। শুরুতে নবাবের অনুরোধে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাওয়ালগণ বাংলাতে আসতেন। নবাবরা তখন কাওয়ালির ভক্ত হয়ে যান। ঢাকার লোকজন তখন কাওয়ালি চর্চা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ঢাকার কাওয়ালগণও নবাবদের আসরে কাওয়ালি পরিবেশনের সুযোগ পান। নবাবরা নানা সময় কাওয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এভাবে, ঢাকার সংস্কৃতির ইতিহাসে কাওয়ালি বিশেষ জায়গা দখল করে নেয়। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ষাটের দশক পর্যন্ত ঢাকায় কাওয়ালি গানের জমজমাট উপস্থিতি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কাওয়ালি গানে ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এ দেশে বসবাসকারী অনেক উর্দুভাষী অবাঙালিরা বিরোধিতা করে। ফলে সাধারণের মধ্যে তাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কাওয়ালি গানেও। এ দেশে কাওয়ালি গানের ধারা দুর্বল হয়ে গেলে তার স্থান দখল করে বয়াতিদের পরিবেশিত সহজ-সরল বাংলায় মারফতি,মাইজভান্ডারি ও মুর্শিদি গান। তবে উইকিপিডিয়ার আলোকে জানা যায় আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই কাওয়ালীকে জনপ্রিয় করে তোলেন। পুরান ঢাকার আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন জলসা, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে এ গানের প্রচলন ছিল। কাওয়ালির শ্রোতা এক সময় কেবল পুরান ঢাকা ও নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন দেশের সাধারণ তরুণরাও কাওয়ালি গানের ভক্ত হয়ে উঠেছে।
মূলত উপমহাদেশে সাবরি ব্রাদার্স, নুসরাত ফাতেহ আলী খান,আমজাদ সাবরী ও ফরিদ আয়াজ কাওয়ালের মাধ্যমে এই কাওয়ালী ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাংলাদেশে ঢাকার সমির কাওয়াল নাদিম কাওয়াল,চট্টগ্রামে আহমদ নুর আমিরী এদের মাধ্যমে কাওয়ালির জনপ্রিয়তা শুরু হয়। বিশেষত চট্টগ্রামে আমরা দেখতে পাই মাইজভান্ডারি,ইছাপুরী,আহলা ও ফরহাদাবাদী পীরের অনুসারী অসংখ্য অনেক কবি শিল্পী গীতিকাররা কাওয়ালী সংগীত গেয়ে থাকেন। তারা মূলত একযোগে মাইজভান্ডারি গান ও কাওয়ালী দুটোই পরিবেশন করে থাকে।পাকিস্তান ও ভারতে আমজাদ সাবরী,ফরিদ আয়াজ,রাহাত ফাতেহ আলী খান,ওয়ারসী ব্রাদার্সসহ অনেক কাওয়াল বা কাওয়ালি ও সুফি গীতিকবিতার অনেক শিল্পী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভারতের আজমীরে হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতী রহঃ এর দরগায়,দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহঃ এর দরগায়,কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী রহঃ এর দরগায়,ওয়ারেস আলী শাহ রহঃ এর দরগায়,উত্তর প্রদেশ ও হায়দারাবাদে,জম্মু কাশ্মীর,আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় কাওয়ালী হতে দেখা যায়।
ইউরোপ ও আমেরিকাতেও অনেক সুফিরা সামা কাওয়ালি করে থাকেন। বিশেষত নকশবন্দীদের মধ্যে সবাই না করলেও শায়খ মাওলানা নাজিম আল হাক্কানী ও শায়খ হেশাম কাব্বানীর অনেক অনুসারীরা তাদের অনেক অনুষ্ঠান মাহফিলে এই সামা কাওয়ালী গেয়ে থাকেন৷বর্তমানে রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটে কাওয়ালী প্রচারিত হয় এবং এটায় দর্শক সংখ্যা অনেক বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের সফল ব্যবসায়ী,সমাজসেবক ও শিল্পপতি,পিএইচপি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের সুফি মিজানুর রহমানের বাসায় ও তার অর্থায়ন করা জায়গায় প্রতিবছর সামা কাওয়ালির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়,সেখানে বিভিন্ন শর্ত নিয়ম মেনে সামা কাওয়ালি করা হয়। উর্দু,ফারসি,ব্রজ,পাঞ্জাবি ও আরবী ভাষায় রচিত 'ভার দ ঝোলি মেরি ইয়া মোহাম্মদ...', 'তাজেদারে হারাম', 'দমাদম মাস্ত কালান্দার...','মেরা কোয়ী নাহি....' 'লাম ইয়াতি নাজিরু কাফি নাজারিন','অ্যায় মেরে মুর্শিদ, মেরে কামলিওয়ালা','আলী কে সাথ যাহরা কে...', 'আলি কেহ রাহি হ্যায়','মান কুনতু মাওলা','গুফতাম কে রওশান আয ক্বামার' 'ইয়া সাহেব আল জামাল' 'চাপ তিলাক সাব চেনি' 'আজ সিক মিতরান দি' 'খাজা মেরা খাজা' ইত্যাদি কাওয়ালি সংগীত এখনো তুমুল জনপ্রিয়। এসব গানের রচয়িতা আমির খসরু,বুল্লে শাহ,পীর মেহের আলী শাহ,সাবরি ব্রাদার্স প্রমুখ ব্যক্তিগণ। দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর বাংলা সংস্করণের মতে এসব সংগীতের কালামে যেন মিশে আছে অপূর্ব খোদাপ্রেম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বাজারী কাওয়ালীও শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে অনেক ইসলামী নাত গজল শিল্পী বিশেষত সামী ইউসুফের মত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদেরকে হামদ নাত গজলের পাশাপাশি কাওয়ালী গাইতেও দেখা যাচ্ছে৷মূলত ইরান/আজেরবাইজান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জনপ্রিয় ইসলামী সংগীত গজল শিল্পী সামী ইউসুফ ২০১৬ সাল থেকেই এই কাওয়ালী গাওয়া শুরু করেছেন৷ অনেকে বাদ্যযন্ত্রসহ আবার বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই কাওয়ালী গেয়ে থাকেন।
অনেকে কাওয়ালীকে নাজায়েজও বলেছেন। এখানে কাওয়ালী নিয়ে অনেক কিছু বলা হল। এখন আমরা দেখি কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী জীবনবিধানের আলোকে এই কাওয়ালী কতটুকু বৈধ ও অবৈধ।
কুরআনের সুরা লুকমানের ৬ নাম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে কাসীর,তাফসিরে কুরতুবী,তাফসিরে জালালাইন,তাফসিরে মা'আরিফুল কুরআন, তাফসিরে তাওযীহুল কুরআনের আলোকে বাদ্যযন্ত্র মানুষকে গাফেল করে তাই বাদ্যযন্ত্র বর্জনীয়৷আর প্রচলিত কাওয়ালীতে অধিকাংশ সময়েই বাদ্যযন্ত্র ঢোল হারমোনিয়াম তবলা বাঁশি রাবাব ব্যবহৃত হতে দেখা যায়৷বিশেষত মাইজভান্ডারি সহ এজাতীয় অনেক পীরের অনুসারীরা একে জায়েজ মনে করে।রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন "আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।"-সহীহ বুখারী হাদীস : ৫৫৯০
রাসূলুল্লাহ সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে এ কথা প্রমাণিত রয়েছে যে,তারা কাসিদাহ গজল শে'র ইত্যাদি বলেছেন,শুনেছেন এবং অন্যকে শে'র কাসিদাব বলার জন্য বলেছেন।সফরে এবং বাড়িতে,তাদের মজলিস সমূহে এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে সর্বত্রই এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।একককন্ঠে যেমন হযরত হাসসান বিন ছাবিত রাযি, হযরত আকওয়া বিন আমির রাযি এবং আনজাশাহ রাযি এর একক কন্ঠে কাসিদাহ/গজল প্রমাণিত রয়েছে। সম্মিলিত কন্ঠে যেমন হযরত আনাস রাযি এর হাদীসে খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে,
যখন রাসূলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কেরামদের ক্ষিদামন্দা দেখলেন,এবং ক্লান্তিকে অনুভব করলেন,তখন তিনি নিম্নোক্ত শে'র আবৃত্তি করলেন,
" اللهم لا عيش إلا عيش الآخرة * فاغفر للأنصار والمهاجرة "
অর্থ-হে অাল্লাহ! আখেরাতের জীবন ব্যতীত অন্য সকল জীবন তুচ্ছ। সুতরাং আনসার এবং মুহাজিরদের তুমি ক্ষমা করে দাও।
সাহাবায়ে কেরাম জবাবে বললেন,
نحن الذين بايعوا محمدا * على الجهاد ما بقينا أبدا
আমরা তারাই, যারা মুহাম্মদ সাঃ এর হাতে আমৃত্যু জীহাদের জন্য বায়আত গ্রহণে করেছি।
(সহীহ বোখারী-৩/১০৪৩)।হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া বলেছেন "১. যিনি ‘সামা’ বলবেন, তিনি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হতে হবে। মহিলা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে হলে চলবে না।
২. ‘সামা’ আল্লাহ-রাসূলের মহব্বত বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে হতে হবে। অর্থাৎ সামা শ্রবণকারী আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হতে পারবে না।
৩. যা ‘সামা’ হিসেবে আবৃত্তি করা হবে তা মন্দ, অযথা উপহাসমুক্ত হতে হবে।
৪. সামার অনুষ্ঠান বাদ্যযন্ত্র মুক্ত হতে হবে।
উপরিউক্ত শর্তের ভিত্তিতে ‘সামা’ হালাল বলে সাব্যস্ত হবে।’ [মাকালু-ই উরাফা, পৃ.-৩৮]
দুররুল মুখতার গ্রন্থের মতে "যদি কবিতা, সংগীত ইত্যাদির মধ্যে ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে এমন সংগীত বা কবিতা শোনায় ইসলামের বাধা নেই। তবে যদি (বর্তমান যুগের সংগীতগুলোর মতো) ইসলামী ভাবধারা ও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা হয়, তাহলে অবশ্যই তা হারাম।" (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩৪৯)। একই মত ঢাকা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকীও পোষণ করেছেন৷
প্রচলিত কাওয়ালির ব্যাপারে ‘ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া’র (পুরনো সংস্করণ : ১৭/৪৫৪) বরাত দিয়ে ‘ফাতাওয়ায়ে কাসেমিয়া’য় বলা হয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন কাওয়ালি অনুষ্ঠানে যে কাওয়ালি গাওয়া হয়, সেগুলো নাজায়েজের পর্যায়ের। এগুলো আর সিনেমার গানের বিধান একই। দুটিই নাজায়েজ ও গুনাহর কাজ। [ফাতাওয়ায়ে কাসেমিয়া, মাকতাবায়ে জিবরিল] : ২৪/৪৯৩]
Comments
Post a Comment