মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
এম এম মাহদী হাসান
______________________________________________
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন
يا ايها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون »
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেমনি ভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর ফরজ করা হয়েছিল যেন তোমরা তাকওয়াবান হতে পারো (সূরা বাকারা আয়াত: ১৮৩)
রমযানের তাৎপর্য:
সওম শব্দের শাব্দিক অর্থ: বিরত থাকা
পরিভাষিক অর্থা: সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার, কামভাব ও স্ত্রী সম্ভোগ করা থেকে বিরত থাকা (তাফসীরে ইবনে কাসীর ও রুহুল মা'আনী)
প্রেক্ষাপট:
আলোচ্য আয়াতটি দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে অবতীর্ণ হয় এবং এ আয়াতের মাধ্যমে রমজান মাসের রোজা ফরজ হয় (মিরকাত শরহে মিশকাত)
পূর্ববর্তী উম্মতের উপর রোজা ফরজ ছিল তবে কোন রোজা ফরজ ছিল সে সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামগনের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে।
কোন কোন ওলামায়ে কেরামগণ বলেন-
পূর্ববর্তী উম্মতগণ এর উপর প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। কেউ কেউ বলেন
আশুরার দিন অর্থাৎ মুহাররম মাসের ১০ তারিখের রোজা ফরজ ছিল।
(বাইহাকী, উমদাতুল ক্বারি শরহে বুখারী, কিতাবুত সওম তানজিমুল আশতাত শরহে মিশকাত, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে কুরতুবী)
ঈমাম শা'বী ও কাতাদা রহিমাহুমাল্লাহু হতে বর্ণিত, আয়াতে পূর্ববর্তী উম্মতগণ এর ধারা উদ্দেশ্য হল মুসা ও ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত গণ অর্থাৎ ইহুদী-নাছারা। তাদের উপর রমজানের ৩০ রোজা ফরজ ছিল কিন্তু তাদের ওলামায়ে কেরামগণ আরো ১০ টি রোজা বাড়িয়ে ৪০ টি রোজা আদায় করতে থাকে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে কতক ওলামায়ে কেরাম অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তারা মানত করেন যে যদি তারা সুস্থ হন তাহলে আরো ১০ টি রোজা বাড়িয়ে মোট ৫০ টি রোজা রাখবেন।
পরবর্তিতে দেখা গেলো গরমকালে তাদের রোজা রাখতে খুব কষ্ট হতো পরে তারা গরমকালের রোজা না রেখে বসন্তকালে রোজা রাখা শুরু করে। (তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে তাবারী)
পরবর্তীতে রমজান মাসের নির্দিষ্ট রোজা ফরজ হওয়ার পরে পূর্ববর্তী সকল রোজা রহিত হয়ে যায় এবং এ মাসের নিদিষ্ট রোজাই ফরজ হিসেবে রয়ে যায়।
সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন
فمن شهد منكم الشهر فليصمه
অর্থ: যে রমজান মাস পায় সে যেন রোজা রাখে। (সুরা বাক্বারা)
আয়াত সম্পর্কিত আলোচনা:
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে সম্বোধন করেছেন।
কুরআনুল কারীমের মধ্যে যদি মুমিনদেরকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয় তাহলে বুঝতে হবে যে এখানে কোন হুকুম বর্ণনা করা হচ্ছে। আর যদি সকল মানুষকে সম্বোধন করা হয় তাহলে আলোচ্য বিষয়ের উপর ঈমান আনয়ন করতে বলা হচ্ছে।
আল্লাহ তাআলা আয়াতে রোজার ফলাফল হিসেবে উল্লেখ করেছেন
لعلكم تتقون
অর্থ: যেন তোমরা তাকওয়াবান হতে পারো।
তাকওয়ার সংজ্ঞা:
তাকওয়া'র শাব্দিক অর্থ: বিরত থাকা।
পারিভাষিক অর্থ:
শরীয়ত নির্দেশিত কাজগুলো পালন করা আর শরিয়ত নিষেধকৃত বিষয়সমুহ থেকে বিরত থাকা। (তাফসীরে বায়যাবী)
তাকওয়া হল সর্বদা সকল প্রকার পাপ পঙ্কিলতা, কাম বাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখা ও উত্তম গুণাবলীর মাধ্যমে নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা।
(তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে রুহুল মাআনী, তাফসীরে ইবনে কাসীর)
রোজার গুরুত্ব:
১. রমজান হলো কোরআন নাজিলের মাস। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, রমজান মাস! এতে নাজিল হয়েছে আল-কোরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী (সূরা বাকারা : ১৮৫)
রমজান মাসে সপ্তম আকাশের লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কোরআন একবারে নাজিল হয়েছে। সেখান হতে আবার রমজান মাসে অল্প অল্প করে নবী করিম সা. এর প্রতি নাজিল হয়।
এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাজিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহ সা. কে পূর্ণ কোরআন শোনাতেন এবং রাসূল সা. ও তাকে পূর্ণ কোরআন শোনাতেন।
২. এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় এবং জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
, إِذَاجَاءَرَمَضَان فتِّحَتْ ابْوَابُ الْجَنَّةِوَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِوَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ
‘‘রামাদান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০০)
৩. এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদরের ন্যায় বরকতময় রজনী।
মহান আল্লাহ বলেন,
لَيۡلَةُٱلۡقَدۡرِخَيۡرٞمِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُوَٱلرُّوحُ فِيهَابِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡر-
লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ ( জিবরাঈল আ.) অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।
(সূরা আল-ক্বদর: ৩-৫)
৪. এ মাস দো‘আ কবুলের মাস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন
إِنَّ لِلَّهِ عُتَقَاءَ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَة
রামাদানের প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দো‘আ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রামাদান মাসে করে থাকে)।
৫. রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন। একটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ
আল্লাহ বলেন, বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
৬. রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণ।
রাসুল সা. বলেন
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَلَهُ مَاتَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১০)
৭. রোযা জান্নাত লাভের পথ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়্যান’ কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। রোযাদারগণ প্রবেশ হয়ে গেলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৭)
৮. সিয়াম রোযাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন: কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেয়নি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহন করুন। ফলে এ দু'য়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।
(মুসনাদ, হাদীস নং ৬৬২৬)
৯. রোযা জাহান্নামের আগুন 🔥 থেকে মুক্তিলাভের ঢাল।
রাসুল সা. ইরশাদ করেন
مامن عبد يصوم يوما في سبيل الله ابتغاء وجه الله إلاباعد الله عن وجه هو بين النار سبعين خريفا.
যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরী করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৪)
১০. এ মাসের রোযা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোযা রাখার সমান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
صيام شهر رمضان بعشرة أشهر وصيام ستة أيام بشهر ينفذ لك صيام السنة
রামাদানের রোযা দশ মাসের রোযার সমতূল্য, ছয় রোযা দু'মাসের রোযার সমান। এ যেন সারা বছরের রোযা।
১১. রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন।
فم الصائم أطيب من ريح المسك
(متفق عليه)
অর্থ: রোজাদারের মুখের গন্ধ মেশক আম্বরের থেকেও অধিক সুগন্ধময়। (বুখারী, মুসলিম)
১২. রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তিলাভের উপায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَ فَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّه
রোযাদারের জন্য দুটো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
উপসংহার:
আত্মশুদ্ধির মাস রমজানুল মোবারক। রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে প্রতিবছর আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। আমাদের উচিত এই মহিমান্বিত মাসকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।কেননা রোজা আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। কারণ হলো এ মাসে আল্লাহ তাআলা মরদুদ শয়তানকে জাহান্নামের অতল গহবরে বন্দী করে রাখেন অন্যান্য মাসে এবাদত বন্দেগী করতে ২টি বাধার সম্মুখীন হতে হয় এক শয়তানের ধোকা দুই নফসের প্ররোচনা।
রমজান মাসে যেহেতু শয়তান বন্দী থাকে এখন এ মাসে উচিত বেশি বেশি রিয়াযত মুজাহাদার মাধ্যমে নফসকে পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে আল্লাহ তাআলার বন্দেগীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমজান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে তার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন আমিন।
দারস প্রস্তুতকারক:
এম এম মাহদী হাসান
মুবাল্লিগ ও সহ সভাপতি, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ চাঁদপুর জেলা।
Comments
Post a Comment