১৮ জিলহজ:দ্বীন ইসলামের ইতিহাসে একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন যেখানে দুইটা ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রথমটা হল রাসূলুল্লাহ সাঃ এর শেষ জীবনের সময়ে বিদায় হজ শেষে গাদীরে খুমে বা খুম্ম কুয়ার এলাকায় আলী রাঃ এর শানে ভাষণ যাকে অনেকে ইয়াউমুল গাদীর বা মাওলার অভিষেক বলে, অপরটি হল ইসলামের তৃতীয় খলিফা,নবীজি সাঃ এর অন্যতম সাহাবী হযরত উসমান ইবনে আফফান রাঃ এর শাহাদাত।
গাদীরে খুমের ঘটনা নতুন কিছু নয় বরং রাসূলুল্লাহ সাঃ এর বিদায় হজের দুইটা ভাষণ(৯ ও ১০ জিলহজে আরাফা ও মীনায়) মত ১৮ জিলহজে গাদীরে খুমের ভাষণের বিষয়টাও হাদিস,সুন্নাহ ও ইসলামের ইতিহাসের আলোকে প্রমাণিত,কিন্তু দুঃখজনক এটা আমাদের বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী লক্ষ লক্ষ মুসলমান এটা জানেনা বরং এ ব্যাপারে অজ্ঞ।একসময় যখন স্কুলজীবনে ২০১৪-২০১৬ সালে আমার বয়স ১২-১৪ বছর ছিল তখন ঈদুল আযহার ছুটি শেষ না হতেই রাস্তায় একটা পোস্টার দেখতে পেয়েছিলাম সেখানে গাদিরে খুমের সেই হাদিস লেখা আছে "আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা",পাশাপাশি লেখা " ১৮ জিলহজ মাওলার অভিষেক দিবস ও ভাবসঙ্গীত সম্মেলন,সৌজন্যে তরিকতে আহলে বাইত বাংলাদেশ ",পরে এটা জানলাম এই তরিকতে আহলে বাইত বাংলাদেশ এটা জিঞ্জিরা চিশতী ও বাউল বয়াতীদের বানানো দল সংগঠন।গাদীরের কথা প্রথম শুনেছি সেই সময়েই,২০১৬সালে আমি ডঃ আল্লামা তাহির উল কাদেরির গাদীর সংক্রান্ত ইংরেজি বইটা একটা ডিভাইসে পড়ে দেখেছি সেখানে গাদীর বিষয়ে অনেক লেখা দেখতে পেয়েছিলাম ও গাদীরের হাদিসও দেখতে পেলাম।শিয়ারা(১২ ইমামী,রাফেদি,ইসমাইলী আগাখানী,বোহরা,নুসাইরি ও যায়েদী)এই ১৮ জিলহজকে তারা ঈদে গাদীর বানিয়েছে,একে তারা সকল ঈদের সেরা ঈদ,আল্লাহর বড় ঈদ বা ঈদুল্লাহিল আকবর عيد الله اكبر(নাউজুবিল্লাহ) বানিয়েছে,আর আহলে বাউল বয়াতী,এদের অনুসারীরা একে মাওলার অভিষেক দিবস নামে পালন করে। এর আড়ালে তারা মূলত গাদীরের হাদিস কে অন্যভাবে উপস্থাপন করে আলী রাঃ কে ইসলামের প্রথম খলিফা বানিয়েছে যা পুরাই বাড়াবাড়ি।যেকারণে এই গাদীরের ঐতিহাসিক দিনকে ঈদে গাদীর নামে পালন করাকে সুন্নি আহলুস সুন্নাহর অধিকাংশ আলেম উলামা বিদাত বলে নিরুৎসাহিত করেছে।বাউল বয়াতী ও তাদের অনুসারীরা গাদীর নিয়ে উল্টাপাল্টা বইপুস্তক প্রবন্ধ গান কবিতা লিখে সেখানে সাহাবায়ে কিরামদের ব্যাপারে মানহানিকর বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।মূলত আব্বাসীয় খেলাফত আমলে বনি বুওয়াইয়া (বনি বুয়া) সরকারের মোয়েজুদ্দৌলা দায়লমী। পারস্যের শাসনকর্তা মোয়েজুদ্দৌলা বাগদাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন এবং সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে খলিফাকে করেন ক্ষমতাহীন এবং ওজিফা ভোগী। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর খলিফা মতীলিল্লাহ এর আমলে (৩৩৪-৩৬৩ হি.) তিনি শিয়া মতবাদের প্রচার প্রচলন শুরু করে দেন। ৩৫১ সালে তিনি ‘ঈদ’ এ ‘গাদীরে খুম’ উদযাপনের সরকারি ফরমান জারি করেন এবং জোরেশোরে, ধুমধামের সাথে ঢাকঢোল বাজিয়ে আনন্দ উল্লাশের নির্দেশ ও ৩৫২ হিজরীতে মুহাররমে আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন রাঃ এর জন্য শোক দিবস পালনের নির্দেশ দেন।তখন থেকেই এসব বিদাত শুরু হয়।আজকাল ভারত,পাকিস্তান,আফগানিস্তান,ইরান,ইরাক,লেবানন,বাহরাইন ও ইয়েমেনে হাজারো ইসনা আশারী ও হুথি যায়েদী শিয়ারা এই গাদীরের দিনকে ঈদ বানিয়ে ১২ রবিউল আউয়াল মিলাদুন্নবী সাঃ এর অনুকরণে তারাও কথিত ঈদে গাদীরের জশনে জুলুসের মিছিল সমাবেশ করতে দেখা যায়,সেখানে হাততালি,বন্দুকসহ অস্ত্রশস্ত্রের আওয়াজ,আতশবাজি,ঘোড়া অথবা উট সহ নাচানাচি ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।আল্লাহ মাফ করুন।
গাদিরে খুমের ঘটনা যা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে (১০হিজরীর)বিদায় হজের পরে ১৮ জিলহজে সংঘটিত হয়। বিদায় হজের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর রসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা হতে মদীনার দিকে যাত্রা করেন এবং ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছেন। এটি ছিল মক্কা হতে তিন মাইল দূরে ‘জোহফা’ নামক স্থান, যা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ‘গাদীর’ অর্থ পুকুর। এখানে পৌঁছার পর রসূলুল্লাহ (সা.) একটি খোৎবা প্রদান করেন। এটিকে বলা হয় ‘গাদীরে খুম’ এর খুৎবা।রসূলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ হতে হজরত আলী (রা.) বিশেষ উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন। ‘গাদীরে খুম’ এ যখন খোৎবা প্রদান করেন তখন হজরত আলী (রা.)ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ করে কেন রসূলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.) সম্পর্কে বললেন, “মান কুনতু মাওলাহু‘ ফা আলীয়্যুন মাওলাহু”। অর্থাৎ- “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।” রসূলুল্লাহ (সা.) এর এ উক্তি থেকে শুরু হয়েছে এক নতুন বিষয়, নতুন মাছআলা, যাকে বলা যায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী মতবাদ তথা ফেতনা।
ইসলামী খেলাফতের মূলে কুঠারাঘাতকারী এ ভ্রান্ত মতবাদ সূচনা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসলেও ইতিহাসে তার গুঞ্জন বিদ্যমান এবং একটি সম্প্রদায়ের মূলমন্ত্র হিসেবে মুসলিম উম্মা বিশেষভাবে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ এর বাইরে অবস্থানকারী একটি কথিত মুসলিম সম্প্রদায় নামে পরিচিত। বিষয়টি খোলাসা করে বলতে হলে প্রথমে ‘গাদীরে খুম’ এ প্রদত্ত রসূলুল্লাহ (সা.) এর খোৎবাটি উল্লেখ করতে হয়।হজরত বোরায়দা (রা.) খোদ নিজেই বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হে বোরায়দা (রা.) আমি কি মোমেনদের জন্য তাদের নিজের চেয়ে উত্তম নই?” আমি বলল্লাম, “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল।” তিনি বললেন, “যার মাওলা আমি, আলী (রা.)ও তার মাওলা।"শু'বাহ বিন সালমান কুহাইল (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, যায়েদ বিন আরকাম বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,"আমি যার মাওলা, আলী (রাঃ)ও তার মাওলা"(সুনানে তিরমিজী,মানাকিব অধ্যায়)।একই হাদিস আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতেও রয়েছে। শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী(রহঃ) বলেন যে,"এই উম্মাহর প্রথম ব্যক্তি হলেন আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) যিনি আধ্যাত্মিকতার দুয়ার খুলে দিয়েছেন "(তাফহিমাতুল ইলাহিয়া)।
শিয়া,ইসমাইলি আগাখানি ও কথিত বাউল বয়াতীরা এই হাদিসকে বিকৃত করে অপপ্রচার চালিয়েছে। গাদীরে খুম’ এর খোৎবা সম্পর্কে হাদীসের আলোকে তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের পর হজরত আলী (রা.) এর পরিবর্তে হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত উমর (রা.) কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করা ভুল ছিল। মওলনা আব্দুর রউফ দানাপুরী (রহ.),আহলেহাদিস সালাফীদের মরহুম মাওলানা যুবায়ের আলী যাইসহ অসংখ্য আলেম এই ভ্রান্ত মতবাদকে বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণ দ্বারা খন্ডন করেছেন।
আহলে সুন্নাতের আলোকে গাদিরে খুমের ঘটনা বিষয়ে সঠিকভাবে জানার জন্যে ডঃ আল্লামা তাহির উল কাদেরির " গাদীরে খুমের ভাষণ",মুফতি নাইমুল ইহসান বারাকাতী( Naimul Ehasan Barkati) এর বিদায় হজের ভাষণ ও শানে কারবালাসহ এজাতীয় বাংলা,ইংরেজি,আরবী ও উর্দুতে রচিত নির্ভরযোগ্য বইপুস্তক,অনলাইনে সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আযহারী সাহেবের প্রবন্ধ,মাওলানা আল্লামা আইনুল হুদা,শায়খ আহমাদুল্লাহ,মাওলানা আহমেদ রেজা ফারুকীর চ্যানেল আইয়ে কাফেলা ডকুমেন্টারি ২০২০, ভারতের মাওলানা সালমান নদভী,পাকিস্তানের মাওলানা তারেক জামিল,মুফতি তারিক মাসুদ,ডঃ আল্লামা তাহির উল কাদেরি,ইঞ্জিনিয়ার আলী মির্জা,রেজা সাকিব মুস্তাফায়ী,পীর সাকিব শামী,মুফতি হানিফ কুরেশী,আল্লামা কাওকাব নুরানী উকাড়ভী,মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের শায়খ সালেহ মুনাজ্জিদ,কুয়েতের শায়খ উসমান খামিস ও শায়খ হাসান আল হুসাইনী,ইংরেজিতে Sunnah Discourse এর ভিডিও আলোচনা ওয়াজ লেকচার শোনার অনুরোধ।
পাশাপাশি ইসলামের ইতিহাসে ১৮ জিলহজের আরেকটা ঘটনা হল ইসলামের তৃতীয় বৈধ খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান রাঃ এর মৃত্যু/শাহাদাত।হজরত ওসমান (রা.) খেলাফতের মসনদে আসীন হয়েই বড় ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হন। উবায়দুল্লাহ ইবনে ওমর হজরত ফারুকে আজমের হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন নাসারা ও মুনাফিক প্রকৃতির মুসলমানকে হত্যা করেন। বিষয়টি খলিফার সামনে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার পূর্বাভাস হিসেবে আবির্ভূত হলো। হজরত ওসমান (রা.) নিজের সম্পদ থেকে নিহতদের ওয়ারিশদের রক্তপণ দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করলেন। ফলে মুসলমানদের ভিতরের সব বিভেদের অবসান হয়। হজরত ওসমান (রা.) অত্যন্ত জনপ্রিয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলেন। কিন্তু খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার সুযোগে স্বার্থান্বেষী চক্র হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার বিরোধ, কোরাইশ-অকোরাইশ দ্বন্দ্ব^, মুহাজির-আনসার সম্প্রীতি বিনষ্ট, ইবনে সাবরে অপপ্রচার, অমুসলিমদের বিদ্বেষ ইত্যাদি কারণে মুসলিম সাম্রাজ্যে এক চরম সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হলো। খেলাফতের অষ্টম বছরে এসে হজরত ওসমান (রা.) স্বজনপ্রীতি, কোরআন দগ্ধীকরণ, চারণভূমির রক্ষণাবেক্ষণ, আবুজর গিফারির নির্বাসন, বায়তুলমালের অর্থ অপচয় ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিরুদ্ধবাদীদের চরম বিরোধিতা ও বিদ্রোহের সম্মুখীন হন।
হজরত আলী (রা.)-এর সমর্থকদের অপপ্রচার বিদ্রোহের আগুনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। অথচ খলিফার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই ছিল মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও অবাস্তব। হাম্মাদ ইবনে সালামা বর্ণনা করেন, ‘ওসমান (রা.) যেদিন খলিফা নির্বাচিত হন, সেদিন তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন। আর যখন তাঁকে লোকেরা হত্যা করল, তিনি সেদিন থেকেও উত্তম ছিলেন যেদিন তাঁকে খলিফা বানানো হয়েছিল।’ রসুলুল্লাহ (সা.) বলে গেছেন, ‘আল্লাহর হিকমত অনুসারে জিননুরাইনের ওপর মতানৈক্য দেখা দেবে এবং লোকেরা তাঁকে শহীদ করবে। অথচ তিনি তখন হকের ওপরই থাকবেন এবং তাঁর বিরোধীরা থাকবে বাতিলের ওপর।’ শেষ পর্যন্ত মিসর, বসরা ও কুফার বিদ্রোহী গোষ্ঠী একাট্টা হয়ে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় সমবেত হয়ে খলিফার পদত্যাগ দাবি করে। হজ উপলক্ষে অধিকাংশ মদিনাবাসী মক্কা গমন করায় তারা এ সময়কেই মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। খলিফা পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তারা হত্যার হুমকি দিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। হজরত ওসমান (রা.) রক্তপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মুষ্টিমেয় বিদ্রোহীর কঠোর শাস্তিদানের পরিবর্তে তিনি তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে থাকলেন। হজরত আলী, তালহা ও জুবাইর (রা.)-এর ছেলেদের দ্বারা গঠিত ১৮ নিরাপত্তারক্ষী বিপথগামী বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় ব্যর্থ হন। অবশেষে তারা ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন হিজরি ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ শুক্রবার আসরের নামাজের পর ৮২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ খলিফাকে অত্যন্ত বর্বরভাবে হত্যা করে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন (আমিন)
Comments
Post a Comment