প্রসঙ্গ : রাজারবাগী দিল্লুর রহমান ও আলতাফুল বারী আলভী অনুসারী মতাদর্শ।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন "দ্বীন ধর্মে কোনো জোরজবরদস্তি নাই"(সুরা বাকারা,আয়াত ২৫৬)। রাসূল সাঃ এক হাদিসে বলেন "শেষ যুগে আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে যারা তোমাদেরকে দ্বীনের নামে এমন এমনসব কথা ও হাদীস শোনাবে যা তোমরা কিংবা তোমাদের পূর্বপুরুষরা কেউ কখনো শোননি। অতএব, তোমরা তাদের সংস্রব থেকে সাবধান থাকবে এবং তাদেরও তোমাদের থেকে দূরে রাখবে"(সহীহ মুসলিম)। অপর হাদিসে এসেছে "আমার উম্মত ৭৩টি দল ফেরকায় বিভক্ত হবে। এর মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামে যাবে আর একটি দল ফেরকা জান্নাতে যাবে"(সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৪১, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস নং-৭৬৫৯)।
অনেক আগে থেকেই কিছু মানুষ ছিল,যারা কুরআন ও সুন্নাহর বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সর্বসম্মত ও স্বীকৃত বিষয় এর বিপরীত মতাদর্শ পোষণ করে মানুষকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করেছে।ইসলামের শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে মুখরোচক ও চটকদার স্লোগানের ছদ্মাবরণে মানুষকে পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামি বানানোর অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে।বর্তমানে সারাবিশ্বে মুসলিমদের মাঝে বিভিন্ন দল উপদল ফিরকা দেখা যায়। আকিদা, আমল ও মতাদর্শগত কারণে অনেক বিভক্তি দেখা যায়। বাংলাদেশসহ আমাদের এই উপমহাদেশে অনেকে ইসলাম বিষয়ে আজব আজব ব্যাখ্যা মতাদর্শে বিশ্বাসী। বিভিন্ন ছদ্মবেশে অনেক ভ্রান্ত দল ও ফিতনা লক্ষ করা যায়।কেউ প্রিয়নবী সাঃ এর খোলাফায়ে রাশেদীন,আহলুল বাইত সাহাবায়ে কিরাম এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে,কেউ ইসলামের সঠিক আকীদার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে আক্রমণ চালায়। কেউ দ্বীনে ইলাহী তাওহীদে আদইয়্যান (সব ধর্মকে এক করে ফেলা) এর মতাদর্শ প্রচার প্রসার করছে, কেউ ইসলামের পর্দার বিধানকে নিয়ে ঠাট্টা করে আবার কেউ জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উগ্র তাকফিরি মতাদর্শ,সন্ত্রাস ও নিরস্ত্র,নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে হত্যা হামলা চালিয়ে থাকে। অনেকে বিভিন্ন ইস্যুতে যেকোনো মুসলিমকে কাফির মুশরিক ঘোষণা করে। এরকম অনেক দল মতাদর্শ ফিরকা উপমহাদেশে দেখা যায়। যেমন শিয়া,ইমামীয়া,রাফেজী,খারেজী,নাসিবী,ইসমাঈলী,নুসাইরি,মুতাজিলা,জাহমিয়া,আহলে বিদআতী,মুনকিরিনে হাদিস মুনকিরিনে সুন্নাহ আহলে কুরআন(হাদিস ও সুন্নাহ অস্বীকারকারী আহলে কুরআন),কাদিয়ানী,হিযবুত তাহরীর,হেজবুত তাওহীদ,নারীবাদী সেকুলার,কতিপয় পীর দরবার যেমন দেওয়ানবাগী,কুতুববাগী,রাজারবাগী,সুরেশ্বরী এজাতীয় পীরগুলো,বাউল বয়াতী,খ্রিস্টান মিশনারী ইত্যাদি। এখানে আলতাফুল বারী ও রাজারবাগীদের প্রসঙ্গে লেখা হল।
আলতাফুল বারী আলভী খিদমত কমিটি : বাংলাদেশের একটা অন্যতম ফিরকা মতাদর্শ হল আলতাফুল বারীয়া বা আলত্বাফুল বারী খিদমত কমিটি। এদের উৎপত্তি হয়েছে চরলক্ষ্যা-কর্ণফুলীর আলত্বাফুর/আলতাফুর রহমান আলাভী/আলভী (মৃত্যু ১৯৯৩) ও বশির উদ্দিন/উদ্দীন আলত্বাফীর মাধ্যমে। এরা অন্যান্য ফিরকা দল মতের মানুষদের থেকে ভিন্ন। এই আলতাফুর রহমান আলভী ও তার অনুসারীরা একসময় চট্টগ্রামের হালিশহর দরবার এর অনুসারী ছিল। আহমদুল ইসলাম চৌধুরী রচিত গ্রন্থ ওয়াইসী হতে আজমগড়ী সিলসিলাহ এবং আলহাজ্ব সৈয়দ সাবের আহমেদ রচিত গ্রন্থ "আয়িনা-ই-মুনীরী(রহঃ)" গ্রন্থে জানা যায় রাউজানের কাগতিয়ার তফাজ্জল আহমদ মুনিরী ও কর্ণফুলী চরলক্ষ্যার আলত্বাফুর রহমান আলাভী(মৃত্যু ১৯৯৩ ইংঃ) এরা হালিশহরের শায়খ হযরত হাফেজ সৈয়দ মুনীর উদ্দীন নুরুল্লাহ (জন্ম ১৮৮১ ইংঃ- মৃত্যু ১৯৫৪ ইংঃ) এর অনুসারী খেলাফত প্রাপ্ত বা খলিফা ছিলেন। উল্লেখ্য হালিশহরের সৈয়দ মুনীর উদ্দীন নুরুল্লাহ আজমগড়ীয়া সিলসিলা ঘরানার অনুসারী ছিলেন এবং তার দরবার এই আজমগড়ী সিলসিলার অনুসারী। এই আজমগড়ী সিলসিলা মূলত আজমগড়ী হযরত হামেদ হাসান আলাভীর থেকে শুরু হয়েছিল।
হালিশহরের হাফেজ মুনীর উদ্দীন নুরুল্লাহ এর জীবনীগ্রন্থসমূহ ও তাদের দরবারের অনুসারীদের মাধ্যমে জানা যায় হাফেজ মুনীর উদ্দীন নুরুল্লাহ তার জীবদ্দশার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে তিনি আল্লাহর ইবাদত ও রিয়াজত(সাধনা) করতেন। যেকারণে তাদের নিকট মাইক ও বাদ্য বাজনা আওয়াজ তাদের নিকট এটা বিরক্তিকর ও অসহ্য হত। যেকারণে তারা মাইকে আযান দেয়া,মসজিদে মাইক ব্যবহার, মাইকে নামাজ পড়া/সলাত আদায় করাকে অপছন্দ ও নিরুৎসাহিত করত । এইসব কারণে হালিশহর দরবার হাফেজ মুনীর উদ্দীন নুরুল্লাহ এর সমাধি সংলগ্ন এলাকায় ও তাদের দরবারের অনুসারীদের মসজিদে মাইক ব্যবহার করা হয়না এবং তাদের পীর জালাল উদ্দিন যখন জানুয়ারি ২০১৯ সালে ইন্তেকাল করেন তখন তার জানাযার নামাজে হাজারো মানুষ উপস্থিত হলেও সেখানে মাইকবিহীন জানাযা হয় ও জানাযায় মুকাব্বির ছিল। এর আগে কুতুবদিয়ার শাহসূফি মালেক শাহ,আমলে নাজাত বইয়ের লেখক বহদ্দারহাট নিবাসী মাস্টার মোজাম্মেল হক,২০১৫ সালে নেত্রকোনার রেজভীয়া দরবার এর আকবর আলী রেজভী এবং ২০১৮ সালে রাউজানে হিঙ্গলা নিবাসী আবু বক্কর এর জানাযা মাইকবিহীনভাবে হয়। হালিশহর দরবার সংক্রান্ত গ্রন্থ আয়িনা-ই-মুনীরি এর ৭২ পৃষ্ঠায় মাইক প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ নছীহত এ অসিয়ত আছে যেখানে তাদের পীর দরবারের মুরিদ ভক্তদের মাইক/স্পিকার যুক্ত ওয়াজ মাহফিল বা যে ওয়াজ মাহফিলে মাইক ব্যবহার করা হয় সেসব মাহফিলে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। যেকারণে তাদের ব্যাপারে যতটুকু শুনেছি তাদের দরবারে আয়োজিত মাহফিলগুলোতে মাইক ব্যবহার করা হয়না। হালিশহরের হাফেজ মুনীর উদ্দীন নুরুল্লাহ এর একজন খলিফা/অনুসারী চরলক্ষ্যার আলতাফুর রহমান আলভী এসব দেখে ১৯৬০-১৯৮০ এর দশকে তার মসজিদ থেকে মাইকবিরোধী মতাদর্শ প্রচার শুরু করে। সে এবং বশির উদ্দিন আলতাফী,আবুল হাসানাত আলভী ও তার অনুসারীরা আলতাফুল বারী খিদমত কমিটি সংগঠন ও দরবার ই মু'মিনীন শরীফ নামে পৃথক দরবার বানায় যাদের স্লোগান হয় "তামাম যান্ত্রিক ইবাদত হারাম ও শিরকে আকবর "। তারা চট্টগ্রাম,শরীয়তপুর ও নোয়াখালীর অনেক জায়গায় জায়গায় পৃথক মসজিদ ও মাদ্রাসা তৈরি করে সেখান থেকে তাদের মতাদর্শ প্রচার শুরু করে। চরলক্ষ্যায় দরবারে মাহবুবীন বায়তুল বারী মসজিদ ও বাকলিয়ায় দরবার মু'মিনীন শরীফ থেকে তাদের এই মতাদর্শের শুরু হয়। তারা ফাতহুল মুবীন ১-৪ (বাংলা ইংরেজি ও উর্দুতে), হাক্কুল ইয়াক্বীন, ছিরাতুল মুস্তাকীম ১-৩ ,মাকতুবাতে আলাভী,ফয়যানে আলাভী,পয়গামে আলাভী,গজবে ইলাহীর কারণ ও প্রতিকার,দাওয়াত নামা ইত্যাদি বই প্রকাশ করে তাদের মতাদর্শ প্রচার করছে। একসময় ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ত্রৈমাসিক আদ দাওয়াত নামে ম্যাগাজিন পত্রিকা প্রকাশ করত তারা।
তারা তাদের মতাদর্শের মধ্যে তারা বলে যে " মাইক বা এজাতীয় যন্ত্রে আযান দেওয়া,নামাজ পড়া,কুরআন তিলাওয়াত,ওয়াজ বয়ান খুতবা করা,মিলাদ সালাত ও সালাম,দোয়া দরুদ যিকির পড়া এগুলো সবই নাজায়েজ হারাম ও শিরকে আকবর, যারা এসব করে তারা মুশরিক,তাদের ইমান নাই,ক্যাসেট,টেপরেকর্ডার,রেডিও ও টিভিতেও এসব করা কুফরী শিরকে আকবর ও কাট্টা হারাম,মাইক রেডিও টিভি এগুলো বাদ্যযন্ত্র এর শামিল "। এইসব বক্তব্য বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। তখন চট্টগ্রামে হানাফী বেরলভী পন্থী অনেক আলেম উলামারা আলতাফুর রহমান আলভীর বিরোধীতা করে বিশেষত হাটহাজারীর ইমাম শেরে বাংলা কাজী আজিজুল হক,মরহুম আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী,জামেয়া আহমদীয়া সুন্নীয়া মাদ্রাসা ও আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদীয়া সুন্নীয়া ট্রাস্ট এর অনুসারী আলেম উলামা যেমন প্রিন্সিপাল আল্লামা অসিয়র রহমান, মরহুম আল্লামা ওবায়দুল হক নঈমীসহ এজাতীয় সমমনা আলেম উলামায়ে কিরামরা। আজিজুল হক শেরেবাংলা তার জনপ্রিয় বিখ্যাত গ্রন্থ দিওয়ানে আজিজে আলতাফুর রহমান আলভী ও তার অনুসারীদের খন্ডন করে কবিতা ছন্দ রচনা করেন।
Comments
Post a Comment