হুথিদের কথা
ডঃ রাগিব সারজানী (বই: শিয়া মতবাদ বিবাদ বনাম ভ্রস্টতা বা শিয়া মতবাদ : ধারণা ও বাস্তবতা)
গত পাঁচ বছর ধরে প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলোর কাছে হুথি - প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্ব পেয়েছে । প্রসঙ্গটি নিঃসন্দেহে জটিল ; তবে এদের পক্ষে এবং বিপক্ষে এত বেশি আলোচনা - সমালোচনা হয়েছে যে , প্রকৃত বাস্তবতা হারিয়ে গেছে আলোচক , সমালোচক , সমর্থক ও বিরোধীদের ভিড়ে । এখন প্রশ্ন জাগতে পারে হুথি কারা ? এদের উত্থানই - বা কী কারণে ? কী তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ? কেনই - বা ইয়েমেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল ? এদের উত্থানের পেছনে বহির্বিশ্বের কি কোনো হাত আছে ? থাকলে তা কতদূর ? পাঠক , বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করব । আশা করছি , নিম্নোক্ত আলোচনাটি একটি জটিল অধ্যায়ের সমাধানে সকলের জন্য সহায়ক হবে ।
বিগত প্রবন্ধে তথা ‘ ইয়েমেনের ইতিবৃত্তে ’ আমরা খুব সংক্ষিপ্তভাবে ইয়েমেন শাসনের ইতিহাস তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি । সেখানে আমরা দেখেছি , যায়দিয়া শিয়ারা সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়েমেন শাসন করেছে । ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হওয়া ইয়েমেনী বিপ্লব পর্যন্ত ইয়েমেনে তারাই ছিল সর্বেসর্বা । সেখানে আমরা আরও দেখেছি ইয়েমেনে চৰ্চিত যায়দিয়া মতাদর্শ এবং ইরান , ইরাক ও লেবাননে অনুসৃত ইসনা আশারিয়া মতবাদের মাঝে থাকা যাবতীয় পার্থক্য । এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বিগত কয়েকটি প্রবন্ধ যেমন , “ শিয়াদের গোড়ার কথা ’ , ‘ শিয়াদের প্রভাব - প্রতিপত্তির
বিস্তার ’ , ‘ শিয়াদের নিয়ে শঙ্কা ' এবং শিয়াদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান এ খোলামেলা আলোচনা করেছি । বিগত প্রবন্ধে আমরা আরও বলে এসেছি , ইসনা আশারিয়া বা ইমামিয়া শিয়াদের চেয়ে সুন্নীদের সঙ্গেই যায়দিয়াদের সম্পর্ক অধিক ঘনিষ্ঠ । বরং তাদের উভয়ের মাঝে বড়ো ধরনের কিছু বিরোধও রয়েছে । ইসনা আশারিয়া মতাদর্শের অনুসারীরা যায়দিয়া মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা যায়েদ ইবনু আলীর ইমামত স্বীকার না করার বিষয়টি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । অপরদিকে ইসনা আশারিয়াদের আকীদাগত ভয়ংকর সব বিদআত তো আছেই , সাথে আরও অনেক বিষয়েই যায়দিয়ারা তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে থাকে । উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : ইমামদের সংখ্যা বারোতে সীমাবদ্ধ রাখা ; তাদেরকে নিষ্পাপ আখ্যায়িত করা ; তাকিয়া , বাদায়াহ ও পুনর্জীবনের আকীদায় বিশ্বাসী হওয়া ; সাহাবীদের গালাগাল করা ইত্যাদি ।পরিশেষে আমরা এ - ও বলেছি যে , ইতিহাস ঘেঁটে ইয়েমেনের ইসনা আশারিয়া শিয়াদের অস্তিত্বই আবিষ্কার করা যায়নি । সুতরাং ইদানীং সেখানে তাদের যে তোড়জোড় চোখে পড়ছে , এর সূচনা বেশিদিন আগের নয় ।আর এর সাথে হুথিদের রয়েছে গভীর সম্পৃক্ততা ।
চলুন এবার আমরা সেদিকেই আগাই ... গোড়ার কথা ঘটনার সূত্রপাত হয় রাজধানী সানআ থেকে ২৪০ কি.মি. দূরে অবস্থিত সা'দা শহরে । যায়দিয়াদের বড়ো একটি অংশ সেখানেই বসবাস করে । ধর্মীয় মতাদর্শ পঠনপাঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালে তারা ‘ইত্তেহাদুশ শাবাব ’ বা ‘যুব পরিষদ ' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে । যায়দিয়া মতাদর্শের তৎকালীন শীর্ষ আলেম জনাব বদরুদ্দীন হুথি ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান । ১৯৯০ সালে ইয়েমেনী ঐক্য সংঘটিত হয় । এতে সকল দল ও সংগঠনের সামনে চিন্তা - ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয় । এই সুযোগে ‘ ইত্তেহাদুশ শাবাব ' নিজেদের নাম বদলে হয় যায় “ হিযবুল হক ’ বা ‘ সত্যের দল ' । এই নামে তারা সমগ্র ইয়েমেনে যায়দিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে । এ সময় জনাব বদরুদ্দীন হুথির ছেলে হুসাইন বদরুদ্দীন হুথির নেতৃত্ব সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । দিনদিন তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে । এই সুবাদে ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ সালে তিনি ইয়েমেন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন ।
ঘটনার এক বাঁকে যায়দিয়ারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে । সে এক ঐতিহাসিক ফতোয়ার ঘটনা , যাতে বদরুদ্দীন হুথি নিজ ঘরনার আলেমদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন । তখন ইয়েমেনের ' জমহুর ওলামায়ে কেরামের মুখপাত্র ছিলেন জনাব মাজদুদ্দীন আল - মুয়াইদী । শায়খ মাজদুদ্দীন ফতোয়ায় বলেন , ইমামতের জন্য হাশেমী গোত্রভুক্ত হওয়ার যে শর্ত ছিল , তা আর এ যুগে প্রযোজ্য নয় । মূলত সেটির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছিল । কিন্তু বর্তমানে জনসাধারণের অধিকার আছে যে , তারা চাইলে উপযুক্ত যে কাউকে ইমাম নির্ধারণ করতে পারে —– চাই সে হযরত হাসান বা হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমার বংশধর হোক বা না হোক । জনাব বদরুদ্দীন হুথি ছিলেন যায়দিয়ার শাখা ' জারুদিয়া ' সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত । চিন্তা - চেতনায় এই সম্প্রদায় ছিল ইসনা আশারিয়া মতাদর্শ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত । মূলত এ কারণেই তিনি উল্লিখিত ফতোয়ার জোরালো বিরোধিতায় লিপ্ত হন ।
বিষয়টি তার সঙ্গে অনেকদূর গড়ালে একপর্যায়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসনা আশারিয়া মতবাদের পক্ষাবলম্বন শুরু করেন । শুধু তা - ই নয় , আয - যায়দিয়া ফিল ইয়ামান নামে একটি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন ; যাতে । তিনি ইসনা আশারিয়া শিয়াদের সঙ্গে যায়দিয়া শিয়াদের সুসম্পর্কের সকল কারণ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন । বস্তুত এতে তিনি যায়দিয়া । মতাদর্শ বাদ দিয়ে যে ভ্রান্ত মতাদর্শ গ্রহণ করেছেন , তার পক্ষে সর্বাত্মক সাফাই গাওয়ার প্রয়াস পান । কেননা , একসময় তাকে দেশ ত্যাগ করে তেহরান যেতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সেখানে কাটাতে হয়েছে অনেকগুলো বছর । বদরুদ্দীন হুথি ইয়েমেন ছেড়ে চলে গেলেও তার চিন্তাচেতনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে আপন গতিতে ; বিশেষত সাদা শহরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে । নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল ; বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে যেন জোয়ার এসেছিল।
এই সময় বদরুদ্দীন হুথির ছেলে হুসাইন বদরুদ্দীন হুথি হিযবুল হক থেকে আলাদা হয়ে যান । এবং নিজের মনোমতো একটি দল গঠন করেন । এর শুরুটা ছিল ধর্মীয় , আদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক দল হিসেবে । বরং উদ্দেশ্য এ - ও ছিল যে , ‘ আল - ইসলাহ ' সংগঠনের ' ব্যানারে ' সুন্নীদের যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছে , তা প্রতিহত করতে তারা ইয়েমেন সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে । কিন্তু কয়েক বছর যেতে - না যেতেই দলটি সরকারের বিরোধিতায় লিপ্ত হয় এবং ২০০২ সালে বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায় ।
এরই মধ্যে ইয়েমেনের কয়েকজন গণ্যমান্য আলেম , বদরুদ্দীন হুথিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি জনাব আলী আবদুল্লাহ সালেহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । রাষ্ট্রপতি তাদের প্রস্তাবে সম্মত হলে বদরুদ্দীন হুথি ইয়েমেনে ফিরে আসেন । এই সুযোগে তিনি তার অনুসারীদের মাঝে নতুনভাবে তার মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে কোমড়ে গামছা বেঁধে নামেন । ইয়েমেন সরকার তখন এ দলটির প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপও করেনি ; ভাবেনি , খাল কেটে এক কুমির আনা হয়েছে , যা একদিন তাকে গ্রাস করতে তার দিকে হিংস্র থাবা বাড়িয়ে দেবে ।
বিশাল বিক্ষোভ এবং যুদ্ধের সূচনা
২০০৪ সালে ঘটে যায় মহাকাণ্ড । হুসাইন বদরুদ্দীন হুথির নেতৃত্বে হুথি সম্প্রদায় মার্কিনীদের ইরাক - আগ্রাসনের বিরোধিতা করে ইয়েমেনের মহাসড়কগুলোতে বিশাল বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে । এসব নিয়ে ইয়েমেন সরকার বড়োসড়ো ঝামেলার সম্মুখীন হয় । এরপর জানা যায় , জনৈক হুথি নিজেকে ইমাম এবং মাহদী দাবি করেছে । এমনকি নবুওয়তের দাবিও নাকি করেছে তাদের একজন । এসব দেখে ইয়েমেন সরকার নড়েচড়ে বসে এবং একপর্যায়ে হুথি শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । যুদ্ধে ত্রিশ হাজারেরও বেশি ইয়েমেনী সেনা অংশগ্রহণ করে ; ব্যবহৃত হয় ট্যাঙ্ক এবং যুদ্ধবিমান । প্রথম সংঘর্ষেই সংগঠনের প্রধান হুসাইন বদরুদ্দীন হুথি নিহত হন , কয়েকশ হুথি যোদ্ধা বন্দি হয় , সরকারের হস্তগত হয় এক বিশাল অস্ত্রভান্ডার । এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় ।
হুসাইন বদরুদ্দীন হুথির অনুপস্থিতিতে সংগঠনের হাল ধরেন তার বাবা বদরুদ্দীন হুথি । এদিকে রাষ্ট্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা আগেই বড়ো ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল ; যা দিয়ে তারা ইয়েমেনী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে টানা কয়েক বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । কাতার ২০০৮ সালে হুথি সম্প্রদায় এবং ইয়েমেন সরকারের মাঝে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় । এই সুবাদে একটি শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় । চুক্তির পরপর হুসাইন বদরুদ্দীন হুথির দুই ভাই ইয়াহইয়া হুথি এবং আবদুল কারীম হুথি তাদের অস্ত্রশস্ত্র ইয়েমেন সরকারের কাছে হস্তান্তর করে কাতারে পারি জমায়।
কিন্তু এ চুক্তি ছিল একেবারে ক্ষণস্থায়ী , যা ভেঙে গেলে আবার নতুনোদ্যমে যুদ্ধ বাধে । এবার তাদেরকে আরও শক্তিশালী দেখা যায় ; ধীরে ধীরে তারা সা'দার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় । এমনকি ইয়েমেনের বাইরে থেকে সমুদ্রপথে সাহায্য লাভের জন্য তারা লোহিত সাগরের উপকূলে নিজেদের ঘাঁটি করতে সচেষ্ট হয় । এখন আর কোনোকিছুই অস্পষ্ট নেই ; সবই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার । সুতরাং সমগ্র ইয়েমেনে কাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে , সেটাই এখন লক্ষণীয় ; কয়েকটি জেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে শিয়াদের হাতে গেল কি - না , তা ধর্তব্য নয় ।
Comments
Post a Comment