হুথি শিয়া প্রসঙ্গ
ডঃ রাগিব সারজানী
Part 2
হুথিদের ক্ষমতার উৎস
বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য যদিও অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা সম্ভব ; কিন্তু সঙ্গত কারণেই কয়েকটি উল্লেখ করছি মাত্র । আশা করি , এতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে । প্রথমত : এ বিষয়টি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে , ইয়েমেনের ছোট্ট একটি জেলায় অবস্থানরত কিছু লোক কোনো রকম বহিস্থ সহায়তা ছাড়াই বছরের পর বছর রণাঙ্গনে টিকে থাকতে সক্ষম হবে । এর সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে , হুথি বিদ্রোহীদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কেবল একটি দেশেরই লাভ ; দেশটি হলো ইরান । ইরান একটি ইসনা আশারিয়া শিয়া রাষ্ট্র ; তাই যে - কোনো মূল্যেই হোক সমগ্র বিশ্বে তারা এ মতবাদ ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ।
সুতরাং যদি তাদের পক্ষে কোনোভাবে ইয়েমেনে হুথিদের ক্ষমতায়ন সম্ভব হয় , তবে সেটি তাদের জন্যও একটি বড়ো অর্জন বলে গণ্য হবে । বিশেষত , এর মাধ্যমে তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র সৌদি আরবকে কোণঠাসা করতে পারবে । কেননা তখন উত্তরে ইরাক , পূর্বে সৌদি - পূর্বাঞ্চল , কুয়েত , বাহরাইন এবং দক্ষিণে ইয়েমেন দ্বারা বেষ্টিত সৌদি আরব একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে ; যা আমেরিকা কিংবা সুন্নী ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ইরানের জন্য সৃষ্টি করবে এক বিশাল সুযোগ ।
এটি কেবল ধারণাপ্রসূত কিংবা কোনো কাল্পনিক বক্তব্য নয় ; এই দাবির পক্ষে একাধিক দলীলও রয়েছে । প্রথমেই উল্লেখ করা যায় , রহস্যজনকভাবে জনাব বদরুদ্দীন হুথির মধ্যপন্থি যায়দিয়া মতাদর্শ ছেড়ে উগ্রপন্থি ইসনা আশারিয়া মতবাদে যোগদানের বিষয়টি । তিনি চকিত মতাদর্শ পরিবর্তন করে ফেললেন ,অথচ ইয়েমেনের ইতিহাসজুড়ে কোথাও ইসনা আশারিয়া মতাদর্শের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না ।মতাদর্শ পরিবর্তনের পর ইরান তাকে একেবারে কোলে তুলে নিল ; কয়েক বছর পর্যন্ত তেহরানে তাকে মেহমানদারিও করল । এসময় বদরুদ্দীন হুথি দেখতে পান — ক্ষমতার মসনদে আরোহণের জন্য খোমেনী কর্তৃক প্রবর্তিত ‘ বিলায়াতুল ফাকীহ ’ আকীদা চমৎকার এক সিঁড়ি ,যাতে রয়েছে ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহার বংশধর না হয়েও ক্ষমতাপ্রাপ্তির সহজ ব্যবস্থা ; অথচ যায়দিয়া মতাদর্শে এমন কিছু কখনই ছিল না । এসব ছাড়াও একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের জন্য কোনো ভিন্নদেশি রাষ্ট্রদ্রোহীকে রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক বা সামরিক সহায়তা প্রদান করা কোনো ব্যাপারই ছিল না ।
সর্বোপরি হুথি ইস্যুতে ইরানের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সাহায্যপ্রাপ্তির ব্যাপারে ইরানের বিভিন্ন শিয়া সংবাদসংস্থা এবং ‘ আল-আলাম ’ ও ‘ আল-কাউছারে ’ - র মতো টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচারণার মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া গেছে । তা ছাড়া ইসনা আশারিয়া শিয়া মতাদর্শের অনুসারী , ইরাকের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ সিসতানীর কাছে হুথিরা মধ্যস্থতা কামনা করেছিল । এমনকি একটা সময় তিনি ইয়েমেনীদের কাছেও ছিলেন বিস্ময় - পুরুষ ; যার হেতু ছিল বিদ্রোহাত্মক মানসিকতার পক্ষাবলম্বন ।
এরপর কথা হলো , ইয়েমেন সরকার একবার তাদের অস্ত্রভান্ডারের উৎস সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেছিল ; বিশেষত হুথিদের ব্যাপারে ; তখন দেখা গেছে সেগুলো সব ইরানের তৈরি । এরপর ইয়েমেন সরকার প্রচ্ছন্নভাবে হলেও হুথিদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারের ইরানের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছিল ; কিন্তু ইরান সরকার অকৃত্রিমভাবেই সেটি অস্বীকার করেছে ।
এটি যে তাদের রাজনৈতিক চাল ,তা কি আর বলে বোঝাতে হয় !? আর ইসনা আশারিয়া শিয়াদের ' তাকিয়া ' আকীদা প্রয়োগের সুযোগ তো থাকছেই — যা তাদেরকে মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েই রেখেছে । তো , আর চিন্তা কী !? দ্বিতীয়ত : হুথিদের এই বিদ্রোহ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে আরও যে বিষয়টি ইন্ধন জুগিয়েছে তা হলো , আন্দোলনের প্রতি অধিকাংশ ইয়েমেনীদের ব্যাপক সমর্থন । দুঃখজনক হলেও সত্য , ওই এলাকার মানুষ হুথিদের ভ্রান্ত মতাদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও কেবল সেখানকার রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্তি পেতেই তাদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছিল । তাছাড়া ইয়েমেনের অবকাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়টি অনস্বীকার্য । সেখানকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র এটাও সত্য ; কিন্তু ওই অঞ্চলের মানুষেরা যেন হতদরিদ্র । সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ছোটো ও বড়ো শহরগুলোর মাঝে যে বৈষম্য , তা - ও লক্ষণীয় ।
২০০৮ সালে কাতারের মধ্যস্থতায় ইয়েমেন সরকার ও হুথিদের মাঝে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির দিকে তাকলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় । সেখানে বলা হয়েছিল , ইয়েমেন সরকার অচিরেই সাদার উন্নয়নে সার্বিক পদক্ষেপ নেবে , এবং কাতার সেসব উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নও করবে ; কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে সকল পরিকল্পনা স্থগিত থাকে । সর্বোপরি প্রত্যক্ষদর্শন হলো , নানাভাবে বৈষম্যের শিকার এবং উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রতিরোধ গড়ে তোলায় জন্য একসময় এমন সম্প্রদায়ের সঙ্গে হাত মেলায় , যাদের সঙ্গে তাদের নৈতিক , আদর্শিক এবং বিশ্বাসগত কোনো মিল নেই । তৃতীয়ত : এই বিদ্রোহ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে ইয়েমেনজুড়ে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকেও দায়ী করা যায় । কেননা ইয়েমেন মানেই অসংখ্য সম্প্রদায় ও অগণিত গোষ্ঠীর সহাবস্থান ; আর যেখানে সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্য থাকবে সেখানে সাদৃশ্য নিরূপণের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই ।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে , হুথি বিদ্রোহীরা বরাবরই সরকার বিরোধী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়ে আসছে । কোনো রকম নৈতিক ও আদর্শিক সম্পর্ক ছাড়াই হুথিদের প্রতি তাদের এই দুর্বলতার একমাত্র কারণ ছিল প্রচলিত শাসনব্যবস্থা , যা তাদের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছিল ।
চতুর্থত : ইয়েমেনের পাহাড়ি ভূ - প্রকৃতিও বিদ্রোহীদের জন্য ছিল যথেষ্ট সহায়ক ; অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে ওই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে আনা ছিল অনেকটা অসম্ভব । কারণ , একদিকে হুথিদের ছিল অসংখ্য গোপন আস্তানা ও গুহা ; অপরদিকে সেনাবাহিনীর ছিল ত্রুটিপূর্ণ পদক্ষেপ , পাহাড়ি পথঘাট সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান এবং সূক্ষ্মভাবে অবস্থান নির্ণয়কারী বৈজ্ঞানিক ডিভাইস ’ ও ‘ স্যাটেলাইট ’ এর অনুপস্থিতি ।
পঞ্চমত : ইয়েমেন সরকারের বড়ো একটি ভুল ছিল এই যে , তারা ইয়েমেনকে উত্তর - দক্ষিণে দ্বিখণ্ডিত করতে চাওয়ার ইস্যুতে সমাধানের দিকে না গিয়ে বরং জিইয়ে রেখেছে । এই দাবির পক্ষে সংঘটিত বিক্ষোভ সমাবেশের বিরুদ্ধে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ; এমনকি ইয়েমেনের সাবেক রাষ্ট্রপতি জনাব আলী সালিম আল - বাইদ — যিনি ছিলেন দক্ষিণ ইয়েমেনের অধিবাসী লন্ডনে বসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও তার ব্যাপারে তারা নিশ্চুপই থেকেছে । বলাবাহুল্য , এ সিদ্ধান্ত ইয়েমেনের সরকার , সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিক্ষিপ্ত করে রেখেছে ; যে কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হুথিদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে । ষষ্ঠত : এই বিদ্রোহ দীর্ঘায়ত হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ উল্লেখ করা যায় । যেমন , ইয়েমেন সরকার নিজেই চাচ্ছিল এই বিদ্রোহ অব্যাহত থাকুক ।
তাদের পরিকল্পনা ছিল , এই ইস্যু দেখিয়ে তারা বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক সহায়ত লাভ করবে । তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল , আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপ লাভ , যা তারা ' সন্ত্রাস দমনের নামে বিভিন্ন দেশে করে থাকে । এ লক্ষ্যে আমেরিকা আল কা/য়ে/দা ও হুথিদের মাঝে সম্পর্ক রয়েছে বলে ইঙ্গিতও করে ।
Comments
Post a Comment