ইবলিসের রাজত্ব - ৭
জিওপলিটিক্যাল গেম খেলতে চাইলে নিজের ফল্টলাইনগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের সামর্থ্য থাকতে হবে। ইরান এই দুইটি বিষয়ে নিজেদের দক্ষতা দেখাতে ব্যার্থ হয়েছে। ইরান শিয়া নিস মার্কেটে খেলতে চেষ্টা করেছে এবং অন্যদের গোলাম বানাতে চেয়েছে। অন্যদের মানে সুন্নিদের। ইজরায়েল এখানে নেহায়েত একটা দীর্ঘ মেয়াদি উটকো ঝামেলা। তারা ইজরায়েল বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার স্লোগান দিয়ে মুসলিম বিশ্বে বাজিমাত করতে চেষ্টা করেছে। তারা প্যান ইসলামিক রাজনীতির বদলে প্যান শিয়া রাজনীতি করায় পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের ফাটলের প্রয়োজনে তাদের সহ্য করেছে। আমি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভক্ত না কিন্তু তার মানে এটা না যে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র হয় না। বরং রাজনীতি মানেই ষড়যন্ত্র। বিপুল পরিমান circumstantial evidence একথা মোটামুটি সুনিশ্চিতভাবে প্রমান করে যে পশ্চিমা চায়ঃ
১) ইরান সুন্নি বিশ্বের জন্য একটা Potent (কার্যকর) হুমকি হিসাবে টিকে থাকুক।
২) ইরান এমন মাপে বনসাই হয়ে থাকুক যেনো ইজরায়েলের হেজিমনি মধ্যপ্রাচ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে না পরে।
আমি মনে করি না ইরান বা খোমেনি গং পশ্চিমাদের সৃষ্টি তবে আমি মনে করি তারা বহুবার পশ্চিমাদের হাতেও ব্যবহৃত।
এই বাস্তবতার উপলব্ধি আরবদের ইজরায়েলের সাথে মৈত্রী করতে উদ্বুদ্ধ করে। শক্তিশালী পক্ষে থাকা তাদের রাজপরিবারগুলো ক্ষমতা ও রাজনীতিকে আপাতত নিরাপদ করে তোলে।
ইরানের পারমানবিক বোমা বানানোর সুনিশ্চিত সম্ভাবনার মুখে এজন্য সুনিশ্চিতভাবেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ইরানের ফল্টলাইন ব্যবহার করে ইরানকে দুর্বল করতে চাচ্ছে। ইরানের ফল্টলাইন হলো বিপুল অশিয়া বা অপারসিদের ক্ষোভকে মোবিলাইজ করা। যে মেয়েটা প্রোপার হিজাব না করায় পুলিশি নির্যাতনে মারা যায় সেই মেয়েটা কুর্দি সুন্নি পরিবারের মেয়ে।
যেহেতু (সুন্নি) ইসলামের ভিত্তিতে লড়াই পশ্চিমা পরাশক্তি, চীন, রাশিয়া, ইজরায়েলের সমর্থন পাবে না সেহেতু ফ্যাসিস্ট চরিত্রের ইরানি মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে ইরানিরা এবং আঞ্চলিক আরব রাজতন্ত্রগুলো এখন সেক্যুলারিজম, লিবারেলিজমকে দার্শনিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। যেমন বাংলাদেশে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বামদের সাথে জোট করছে, জামায়াত-চরমোনাইয়ের ছেলেরা টিএসসিতে কাওয়ালি গাইতে গিয়েছে। রাজনীতিতে ঠিক বেঠিক হিসাবের চেয়ে কার্যকারিতার হিসাব অনেক বেশি হয়। যখন মুসলিম বিশ্বে শিয়া সুন্নি ধর্মীয় আকিদার ভিত্তিতে লড়াই কার্যকর ছিলো তখন আরবরা সুন্নি ধর্মীয় পতাকার ছায়ায় লড়েছ। সিপাহে সাহাবার মতো দেওবন্দি সুন্নি দলকে আরব সালাফিরা সাপোর্ট করেছে। কিন্তু কোল্ড ওয়ারের পরে যখন ইসলাম প্রতিপক্ষ হলো তখন ইসলামের একটা পটেন্ট পলিটিকাল সেক্ট সুন্নি ইসলাম পশ্চিমাদের চক্ষুশূলে পরিনত হয়। শিয়ারা সুন্নি সন্ত্রাস ও সামপ্রদায়িকতার ভিক্টিম বা শিকার হিসাবে শক্তিশালী কাফেরদের ভেতর সহানুভূতি কুড়ায়। এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজেদের রাজনীতি টেকাতে সুন্নি রাজতন্ত্রগুলো শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নিয়তের পরিবর্তে সেক্যুলারিজমের পতাকা হাতে দাঁড়িয়েছে। এটাই সৌদি আরবের MBS এবং আমিরাতের MBZ এর সেক্যুলার রাজনীতির অন্যতম প্রধান কারণ।
৮.
ইরানের সবচেয়ে বড় ফল্টলাইন হলো পশ্চিমা ধারার আধুনিকায়িত বিশাল জনগোষ্ঠী। ইরানের লোকেরা ইউরোপের সাথে বহুদীর্ঘ সময় ধরে ইউরোপের সাথে গভীর যোগাযোগ রাখে। তাদের সম্পর্কের গভীরতা আন্দাজ করতে পারবেন খোমেনির ফ্রান্সে হিজরত থেকে। তিনি মুসলিম বিশ্ব বা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব নয় বরং ফ্রান্স থেকে বিপ্লব করেন।
ইরানি জনগণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আধুনিক পশ্চিমের সাথে গভিরভাবে পরিচিত। খ্রিস্টবাদ যেমন গ্রিকো রোমান প্যাগান চিন্তাধারা আত্মিকৃত করে একটা পৌত্তলিক বিশ্বাসে পরিনত হয়েছে তেমন আলমুত এবং সাফাভি ইবলিসদের রাজত্বের উত্তরসূরী নব্য সাফাভি মাজুসি খোমেনিরা এক বিকৃত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মের ধারক। প্যাগান ধ্যান ধারনা এবং সংস্কৃতি প্রভাবিত খ্রিস্টবাদ যেমন ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের মতাদর্শসমূহের মোকাবেলা করতে ব্যার্থ হয়েছে নব্য মাজুসি, সাফাভি মুশরিক রাফেজি মোল্লাতন্ত্রও অনিবার্যভাবে আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন প্রভাবিত ইরানি জনসাধারণের মানসকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। সত্য বলতে মাজুসি রাফেজি দর্শন ঘৃনা চর্চা এবং এক রাশ কুসংস্কার সম্বলিত শিরকি ধ্যান ধারনা ছাড়া মানবজাতিকে দেওয়ার কিছু নাই। এইতো সেদিন কোভিড মহামারীতে যখন ইরানে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন ইরানি মোল্লারা মানুষকে মহামারী থেকে বাঁচতে বিভিন্ন মাজার মাশহাদের দেয়ালে চুমু খেতে, চাটতে, মান্নত করতে পরামর্শ দেয়। ঠিক যেমন মূর্খ হিন্দুত্যবাদী ব্রাহ্মণরা মানুষকে করোনা, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ থেকে বাঁচতে গোমূত্র খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু গড়পড়তা ইরানিরা গড়পড়তা হিন্দুত্ববাদীদের চেয়ে আধুনিক শিক্ষায় অধিক শিক্ষিত। ফলে তাদের জন্য এসব দেখে শ্রদ্ধা ধরে প্রায় অসম্ভব। ফলে মুসলিম বিশ্বে নাস্তিক্যবাদ ইরানিদের ভেতর সর্বোচ্চ।
পাশাপাশি আরেকটি বড় সমস্যা হলো ইরানি রেজিম দুনিয়ায় তিনটি শব্দ জানে।
১) জায়নবাদ
২) নাসেবি
৩) ওহাবি
জায়নবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ইরানিদের কার্যকর কোন দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামরিক সক্ষমতা নাই। জায়নবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্লোগানবাজির যে আবেদন ষাট, সত্তরের দশকে ছিলো সেটাও আজকাল তেমন নাই।
আকিদা ও চিন্তার জগতে তারা সুন্নিদের যথেচ্ছা নাসেবি/ ওহাবি বলে গালাগালি এবং নির্যাতন করে, খন্ডিত সত্যের মিথ্যাচার করে, ইমামদের এবং রাফেজি মাজুসি পুরোহিতদের পূজা অর্চনা করে কিন্তু নিস্কলুষ তাওহীদের সৌন্দর্য অথবা ইউরোপের বিভিন্ন আধুনিক চিন্তা দর্শনের কালামি খন্ডনের কোন যোগ্যতা বা কাজ তাদের উপযুক্ত মাত্রায় মোটেই নাই। তাদের আকিদার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিরক, অন্ধ ভক্তিবাদ এবং কুসংস্কার। ফলে পশ্চিমা ধ্যানধারণায় মগ্ন আধুনিক তরুন তরুণীদের দার্শনিক অন্বেষার কোন উপযুক্ত জবাব ইবলিসের রাজত্বের পুরোহিতদের কাছে নাই।
আমাদের সময় প্রচুর পশ্চিমারা মুসলমান হচ্ছে। কিন্তু সেটা বলতে গেলে সুন্নিদের একচেটিয়া অবদান। রাফেজিরা হাজার বছর ধরে কখনো কাফেরদের ভেতর দাওয়াতি কাজ সেভাবে করে নাই। তাদের দাওয়াতের লক্ষ্য মূলত একচেটিয়াভাবে মুসলমানরা এবং বিশেষত সুন্নি মুসলমানরা। রাফেজিরা তাওহীদের চর্চা কখনো করে না। তাদের দাওয়াতের ভিত্তিই হলো আবু বকর, উমার, উসমান, আয়েশা প্রমুখ সাহাবাদের ব্যাপারে ঘৃনা চর্চা। অর্থাৎ আল্লাহর উপর নিরংকুশ আস্থার এবং তায়াল্লুকের বদলে একটা বিভৎস নেগেটিভিটি হলো দাওয়াতের মূলকথা। একজন মানুষ যার ইসলাম নিয়ে কোন আগ্রহ নাই তাকে এসব ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক কেচালে কিভাবে আকর্ষণ করতে পারে? সে বরং এটাই বুঝবে যে ইসলাম হলো কিছু দুনিয়াদার ধান্দাবাজ মানুষের ধর্ম। শিয়াদের দাওয়াত শুনলে দুইটি জিনিস মনে হতে পারে
১) আলী (রা) এক দেবতা। মুহাম্মদ (সা) সেই দেবতার প্রতি মানুষকে ডাকতে দুনিয়া এসেছিলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
২) মুহাম্মদ (সা) দুনিয়াতে এসেছিলেন মূলত তাঁর পরিবারের রাজতন্ত্র কায়েম করতে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদের ভেতর এক অন্তহীন গেম অব থ্রোন শুরু হয়। তাদের অনুসারীরা দেড় হাজার বছর ধরে আজ পর্যন্ত সেই গেম অব থ্রোন খেলেই যাচ্ছে। (নাউজুবিল্লাহ)
এক কথায় ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ বা আগ্রহ নাই এমন কোন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বা আত্মিক সংকটের কোন হৃদয়গ্রাহী শক্তিশালী কমপেলিং সমাধান রাফেজি পুরোহিতদের কাছে মোটেই নাই।
এই সকল দার্শনিক ব্যার্থতা চূড়ান্ত মাত্রা পায় যখন উপযুক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং প্রজ্ঞা ব্যাতিত ইসলাম ও আধুনিকতার সমন্বয়ের নামে কথিত ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইচ্ছা মতো গোঁজামিল দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ হিজাব ইস্যুতে নিহত মেয়েটার ঘটনার দিকেই নজর দেওয়া যায়। ইরানিদের এক মুখোরোচক স্লোগান হলো, হিজাব করে সব করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো হিজাব করে অবশ্যই সব করা যায় না। অনেকের অনেক রকম সমস্যা হয়। গরম বা অন্য কোন শারীরিক সমস্যায় হিজাবে কিছুটা ছাড় দেওয়া অত্যন্ত জরুরী নয়তো অনেক কিছু করা সম্ভব না। আপনি যদি নিহত মেয়েটির ছবি দেখেন তবে দেখবেন সে কিন্তু অশালীন পোশাক পরে ছিলো না। তার কিছু চুল বের হয়ে ছিলো মাত্র। এখন অনেক কথা বলা সহজ। কিন্তু বাস্তবে ছাড় দিতেই হয়। আপনি যদি চান মেয়েরা সঠিকভাবে হিজাব মানবে তবে তাদের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাহিরে যাওয়া কমাতে হবে। কিন্তু ইরানিরা বহু আউল বাউল করে এমনসব কথা বলবে এবং এমনভাবে কড়াকড়ি করবে যে মেয়েরা আরও বেশি হিজাব বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। তারপর ধরেন মুতার নামে তারা হালাল পতিতালয় খুলেছে। ইসলামের নামে অন্তহীন দুর্নীতি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি নেশাগ্রস্ত তরুন তরুণী হলো ইরানের। কথিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র এসব বন্ধে শোচনীয়ভাবে ব্যার্থ হয়েছে।
উপসংহারে বলা যায় ইউরোপীয়রা যেমন ক্যাথেলিক পাদ্রীদের ধর্মের নামে ভন্ডামি দেখে আস্থা হারিয়ে ফেলে একইভাবে ইরানের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ রাফেজি মাজুসি মোল্লাদের ধর্মীয় ভন্ডামি দেখে পশ্চিমা প্রোপাগাণ্ডার সহজ শিকারে পরিনত হচ্ছে এবং ধর্মে আস্থা হারাচ্ছে। ইরানের রাজনৈতিক মোল্লারা শিয়া ধর্ম ও আকিদার যে বিপর্যয় ঘটিয়েছে সেটা আকাশে নিচে জমিনের উপর আর কারও জন্য অসম্ভব ছিলো।
সমাপ্ত
Comments
Post a Comment