প্রসঙ্গ: সাহরি ও ইফতারে ডাকাডাকি ও তোপধ্বনি এবং ঢাকার মজান ও ঈদের কাসিদা এর ঐতিহ্য
-আহসান উদ্দিন
⚫ রমজানের কোন একদিন পুরান ঢাকার কোনো এক এলাকায় রাত তিনটার দিকে রাস্তায় উচ্চশব্দে কিছু লোক উর্দু ও বাংলাতে বলছে " ওঠো, রাত তিন বাজ গাইয়্যি হ্যায়,আল্লাহ নবী কে পেয়ারো সাহরী কর"। অনেক বিল্ডিংয়ের মানুষ ঘুম থেকে উঠলো।
⚫কাতার অথবা বাহরাইনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে রমজান মাগরীবের আযানের আগে একটা দূর্গ থেকে তোপধ্বনির দৃশ্য সম্প্রচার করছে।
⚫ঢাকায় এক এলাকাতে রমজানের এক দিন। ইফতারের সময় হয়ে গেল। মসজিদে মাগরিবের আযান দেয়ার ৫ সেকেন্ড আগেই হঠাৎ সাইরেন ধ্বনি বাজল।
উপরোক্ত উদাহরণগুলো দিলাম এখানে। অনেকেই জানেই না এই তিনটা দ্বারা কি কি বোঝায়। অনেকের কাছে উপরোক্ত জিনিসগুলো নতুন। হ্যাঁ অনেকের কাছেই এইগুলা নতুন। আমি বলছি রমজান মাসে সাহরীর সময়ের ডাকাডাকি কাসিদা ও ইফতারের সময় সাইরেন/তোপধ্বনি বিষয়ে। বাংলাদেশ সহ মুসলিম বিশ্বে এটা একটা অন্যতম সংস্কৃতিও বটে তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসবের পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা শোনা যায়৷
সাহরিতে ডাকাডাকি করাটা বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান,মালদ্বীপ,আফগানিস্তা ন,ইন্দোনেশিয়া,মালয়েশিয়া,ব্রুনে ই,ইরান,ইরাক,ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জায়গায় ও তুরস্কে খুবই জনপ্রিয়,আরব দেশগুলোতে এই ডাকাডাকিকে মিসাহারাতি المساحراتي বলা হয়ে থাকে । ঢাকায় বিশেষত পুরান ঢাকায় ও উর্দুভাষী বিহারী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় একে "কাসিদা " বলে,ঢাকার পঞ্চায়েত গুলোতে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে সাইরেন ব্যবহার শুরু হয় যা আজও চলে। । ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য এর সাথে এই কাসিদার অনেক সম্পর্ক আছে। পরবর্তীতে মসজিদে সাহরীর জন্য ডাকাডাকি শুরু হয় যেখানে কুরআন তিলাওয়াত,হামদ নাত নাশিদ ও দোয়া দরুদ যিকির সহ ডাকাডাকি করা হয়ে থাকে। শাব্দিক দিক থেকে কাসিদা শব্দের অর্থ কবিতা। কাসিদা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে আরবি ক্বাসাদ থেকে। ক্বাসাদ শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ । ক্বাসাদ বিবর্তিত হয়ে ফারসি কাসিদায় রূপান্তরিত হয়েছে । সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে কবিতায় প্রিয়জনের প্রশংসা করা হয় তাকে কাসিদা বলে।প্রাগ-ইসলাম যুগে আরব কবিগণ এর সূচনা করেছিলেন।মহানবী মুহাম্মদ সাঃ, তার খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরামদের জীবদ্দশায় এই কাসিদা ছিল। কাসিদা সমূহের মধ্যে জনপ্রিয় হল শরফ উদ্দিন আল বুসিরী ও তার কাসিদায়ে বুরদা,জালাল উদ্দিন রুমী,আব্দুর রহমান জামী ও ইবনে আরাবীর কবিতা সমূহ।
উপমহাদেশে প্রথম কাসিদা রচনা করেন আমির খসরু। মুগলপূর্ব যুগে কাসীদা রচয়িতা হিসেবে সালমান সাওয়াজী ও হুম্মাম তাবরিজির নাম উল্লেখযোগ্য। মুগল যুগে কাসীদা বিশেষ পদ্ধতিতে লেখা হতো। এজন্য এ পদ্ধতি ‘সুবক-ই-হিন্দি’ বা ভারতীয় পদ্ধতি নামে অভিহিত। মুগল আমলে যাঁরা কাসীদা রচনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁদের মধ্যে আকবরের সময়কার ফায়জী ও উরফী, জাহাঙ্গীরের আমলের নাজীরী ও তালিব আমিনী, শাহজাহানের আমলের কবি কুদসী মাশহাদী ও কালীম আবু তালিব এবং পরবর্তীকালে কবি আসাদুল্লাহ খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।বাংলাদেশে কাসিদার প্রচলন মুঘলদের হাত ধরে। ১৬০৮ সালে সুবাদার ইসলাম খানের সাথে মুঘল সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঢাকায় কাসিদার বিকাশ ঘটে।রাজবন্দনা, আল্লাহ-নবীজির সিফত, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হত এসব কাসিদায়। ঊনিশ শতকের পর থেকে রমজান মাসে কাসিদা পাঠের ধুম পড়ে যায় ঢাকার অলিতে গলিতে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে কাসিদা চলত। কাসিদার ইতিহাস নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকা পাচাশ বারাশ পাহেলে নামক গ্রন্থে কাসীদার পুনর্জাগরণের কথা উল্লেখ করেন।এ সময়ের অন্যান্য সূত্রও তার উদ্ধৃতি সমর্থন করে। জানা যায় তৎকালীন নওয়াব ও সরদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিল কাসীদা। তবে সে সময়ে কাসিদা চর্চা সীমিত হয়েছিল রমজান মাস ও ঈদের মধ্যে। সেই সময়ের সংগৃহীত কাসিদার কালাম থেকেও বোঝা যায় যে, দরবারি বিনোদন থেকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে কাসীদার উত্তরণ। কাওয়ালী,শাহেদী,ভৈরবী,মর্সিয়া, হামদে বারী তায়ালা ও নাতে রাসূল,মালকোষ,উর্দু ও হিন্দি চলচ্চিত্রের গান এর সুরে এই কাসিদাগুলো গাওয়া হতো।
রমজান মাসে শেষ রাতে সাহরীর সময়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে কাসীদা। অধিকাংশ কাসিদা উর্দু,ফারসি ও আরবী ভাষায় গাওয়া হতো।আরবি ক্বাসিদার সংখ্যা হাতে গোনা। যেগুলো এখন পুরান ঢাকাবাসী বা ‘সালারে কাফেলা’র কারোরই মুখস্থ বা সংগ্রহে নেই। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ক্বাসিদাগুলো নিয়ে একটি সিডি তৈরি করেন ক্বাসিদাপ্রেমীরা। সেখানেও কোনো আরবি ক্বাসিদার উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
পরে ১৯৭১ সালের পরে বাংলা ভাষায় কাসিদা গাওয়ার প্রচলন শুরু হয়। যারা কাসিদা রচনা করেন ও কাসিদা গায় যারা তাদের মধ্যে সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণির উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। পাকিস্তান আমলেও ঢাকার অনেক মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা ও ডাকাডাকি চলতো,ঢাকার অনেক মহল্লায় কাসীদা প্রতিযোগিতা হতো,তখন ৩০-৪০ টি মহল্লায় কাসিদা প্রতিযোগিতা হতো । আমার বাবার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে ঢাকার সূত্রাপুর সহ অনেক জায়গায় পাকিস্তান আমলে রমজানে সাহরির সময়ে ডাকাডাকির জন্য মুড়ির টিন,ঢোল ও সানাই ব্যবহার হতো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা বন্ধ হয়,কাসিদা ও এর প্রতিযোগিতা অনেক কমে আসে যা বর্তমানে ১১-১৫ টি মহল্লায় হয় । যারা কাসিদা গায় তাদেরকে ক্বাসিদ বলে ও কাসিদার দল পরিচালনা করেন তাদেরকে কাফেলা ও সালারে কাফেলা বলে। এই কাসিদাকে কয়েকভাগে ভাগ করে গাওয়া হয়ে থাকে। ১. চাঁনরাতি আমাদ বা আমাদী কাসিদা ২.ফাযায়েলী বা খোশ আমদেদ কাসিদা ৩. রুখসাত বা আল বিদায়ী কাসিদা ৪. সাহরীর কাসিদা বা বিশেষ কাসিদা এবং ৫. ঈদ মোবারক কাসিদা। বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকাসহ যেসব এলাকায় সাহরিরি জন্য ডাকাডাকি করে কাসিদা গায় সেখানে বাংলা ও উর্দুতে কাসিদা গাওয়া হয়।
১.চাঁনরাতি আমাদ বা আমাদী কাসিদা এটা মূলত রমজানের প্রথম তারিখ থেকে ৫ অথবা ১০ তারিখ পর্যন্ত গাওয়া হয়ে থাকে,যেখানে রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে ও আল্লাহ - নবিজীর শান মান কবিতা গজল গাওয়া হয় ।
উদাহরণ : চাওদ উই তারিখ কা হ্যায় চান্দ ইয়ে রামাজান কাদখলো ইয়ে বাহাসে রাহাত হ্যায় জিসমো জানকা
পাঁচ ওয়াক্ত কা মোমেনা পড়তে রাহো হারদাম নামাজ দহান তুমকো হ্যায় আগার কুচ দিন কা ইমান কা
(সময়কাল: ১৯৫০, রচনা: এজাজ, সুর: শাহেদী, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)
বা
লেকার খুশিকা ইয়ে পায়গাম দার পার
আয়া হ্যায় রামজান আল্লাহু আকবার
ফারিশতে লুটাতে হ্যায় খাযানা
আয়া হ্যায় ফির সে খুশিকা যামানা
(কণ্ঠ: রিয়াজ আশরাফী)
২ ফাযায়েলী বা খোশ আমদেদ কাসিদা মূলত ৬ - ১৬ রমজান পর্যন্ত অথবা রমজানের দ্বিতীয় দশকে তথা ১১ থেকে ২০ রমজান পর্যন্ত দিনগুলোতে গাওয়া হয়ে থাকে সেখানে রমজানের ফজিলত,ইসলামের সৌন্দর্য,আল্লাহ তায়ালা ও মহানবী সাঃ এর শান মান থাকে ।
উদাহরণ : খুশ আমদিদ খোশকে লাব পার আবরে রাহমাত খোদ নিসাওয়ার হো গায়া
মারাতাবে মাহে কারামসে দেকতেহি আজ হামৃ
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচয়িতা: মুনসেফ, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)
৩.রুখসাত বা আল বিদায়ী কাসিদা মূলত ১৬/১৭ রমজানের পরে অথবা রমজানের শেষ ৯ / ১০ দিনগুলোতে গাওয়া হয়ে থাকে সেখানে হযরত আলী রাঃ এর শান,শবে কদর,রমজানের বিদায়,বিরহ নিয়ে কবিতা গজল গাওয়া হয়ে থাকে।
উদাহরণ : অ্যায় মাহে মোবারাক মাহে কারাম
যানেকা আভি সামান নাহ্ কার
(সময়কাল: ১৯৫৫, রচয়িতা: এজাজ, সুর: কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)
বা
মুমিন কি দুয়া হ্যায় মাহে মুবিন
ফির আগলে বারাস দিদার মিলে
(রচয়িতা : কবি তালিব কবির)
৪.বিশেষ কাসিদা বা সাহরীর কাসিদা মূলত রমজান মাসের সাহরির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য যে কাসীদা গাওয়া হতো তা নির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতিকে অনুসরণ করত না। এ ক্ষেত্রে দলীয় পরিবেশনা বা সুনির্দিষ্ট চরণও রচনা করা হতো না। বিশেষ এ কাসীদা গায়কেরা ইবাদতের অংশ হিসেবে রোজাদারদের ঘুম ভাঙ্গাতেন। এ কাসীদা গায়কেরা আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন না।
উদাহরণ : আল্লাহকা বান্দেকো হাম আয়ো জাগানেকো
হার দিলমে রামজানকি পায়গাম পৌছায়ঙ্গে
(সময়কাল ১৯৫০-৫৫, রচয়িতা: আনোয়ার হোসেন, সুর: হিন্দি দার্দ ছায়াছবির গানের সুরের অনুকরণে, কণ্ঠ: আনোয়ার হোসেন)
৫. ঈদ মোবারক কাসিদা মূলত পবিত্র রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের দিন বা ঈদের দ্বিতীয় দিন বিশেষত ঢাকায় আয়োজিত ঈদ আনন্দ মিছিলে গাওয়া হয়ে থাকে। রমজানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত না হলেও ঈদ মোবারক কাসিদায় অনেকে ঢোল তবলা হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন।
উদাহরণ : লুটল অ্যায় সায়োমো মারাকানা ইল্লাল্লাহাকা
ঈদকি দিন হ্যায় পিও পায়মানা ইল্লাল্লাহাকা
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচয়িতা: মুনসেফ, সুর: কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর,গেন্ডারিয়া,কুলুটোলা, রূপলাল দাস লেন,ফরাশগঞ্জ,বাংলাবাজার,সদরঘা ট,লক্ষীবাজার,কোতোয়ালি,বংশাল, নয়াবাজার,ওয়াইজঘাট,চকবাজার,সা তরওজা,উর্দুরোড,হোসেনী দালান,লালবাগ,নারিন্দা,ওয়ারী টিপু সুলতান রোড ও বখশী বাজার এলাকায়,মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প ও মিরপুর বিহারি এলাকায় এই কাসিদা চলতো। তবে এখন এসব এলাকার মধ্যে অনেক এলাকায় কাসিদার পরিবর্তে স্বাভাবিক ডাকাডাকি হয়ে থাকে। ১০ বছর আগে ধোলাইপাড় ও ফরিদাবাদেও কাসীদা হতো । "ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী" গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭-এর পর উদুর্ভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে ক্বাসিদায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। পুরান ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় ভোররাতে ক্বাসিদা গায়কেরা বেরিয়ে পড়তেন। গান গেয়ে ঘুম ভাঙাতেন। এটিকে তাঁরা সওয়াবের কাজ মনে করতেন। আর ঈদের দিন মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরানা নিয়ে আসতেন। আগাসাদেক রোডের ইমরান আহমেদ বলেন, এখন রেকর্ডারে কাসিদা বাজানো হয়। বড় স্পিকারে কাসিদা বাজে আর কাসিদা দল এলাকা ঘুরে মানুষদের জাগিয়ে তোলে।(দৈনিক সময়ের আলো ২৪ এপ্রিল ২০২২)। পুরান ঢাকা ছাড়াও ৯-১২ বছর আগে খিলগাঁও,আজিমপুর, মালিবাগ,মুগদা,কমলাপুর,গোপীবাগ ও রামপুরা এলাকায় কাসিদা চলত ।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হাশেম সুফীর মতে " রমজানের কাসিদায় প্রথমদিকে কয়েকবছর কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হতো না পরে কয়েকবছর পরে সেখানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে "। যার কারণে দেখা যায় বর্তমানে পুরান ঢাকার অনেক জায়গায় সাহরিতে ডাকাডাকির কাসিদায় অনেকে বাদ্যযন্ত্র সহ কাসিদা গায়। ১৯-২০ শ শতকে যারা কাসিদা রচনা করতেন তাদের অধিকাংশেরই জন্ম পুরান ঢাকার হোসেনি দালান, লালবাগ,উর্দু রোড,সাতরওজা,বংশাল,শিংটোলা,ওয়া রী টিপু সুলতান রোড,ধোলাইখাল,ফরিদাবাদ,আজিমপুর, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর বিহারি ক্যাম্প,আদমজী,নারায়ণগঞ্জ,নীলফা মারীর সৈয়দপুর,ভারতের হায়দরাবাদ,বিহার,উত্তর প্রদেশ,পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের করাচী,রাওয়ালপিন্ডি,লাহোরে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, মুনসেফ, এজাজ, হামিদ-এ-জার, হাফেজ দেহলভি, জামাল মাশরেকি, উস্তাদ তালিব কবির, মুজিব আশরাফি, সারওয়ার, শওকত প্রমুখ।সুর ও কণ্ঠে যাদের বিশেষ অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, বংশীবাজারের মো. জুম্মন মিয়া(১৯৩৭), উর্দু রোডের মঞ্জুর আলম(১৯৪৪), আমলীগোলার আনোয়ার হোসেন(১৯৩৭), বংশীবাজারের মানিক চাঁন(১৯৫২), হোসেনি দালানের সৈয়দ ফসিহ হোসেন (১৯৫৬) প্রমুখ। এদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী হলেও অনেকে এখনো ক্বাসীদার সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেউ সুরের মাধ্যমে, কেউ কণ্ঠ দিয়ে, কেউ সালারে কাফেলা হিসেবে, কেউ প্রতিযোগিতার আয়োজক বা বিচারকের দায়িত্ব পালন করে ক্বাসিদাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। যার ফলাফল আমরা এখনো রমজানের ভোর রাতে পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে দেখতে পাই। Qasida of Dhaka নামে অনার্য মুর্শিদের একটা তথ্যচিত্রও আছে এই কাসিদা নিয়ে। বর্তমানে ঢাকার পঠিত অধিকাংশ কাসিদাগুলো মূলত উস্তাদ তালেব কবির এর রচিত যিনি ২০২০ সালে জেনেভা ক্যাম্প এ মারা গিয়েছেন।
৮০-৯০ এর দশকে হোসেনি দালান পঞ্চায়েত সমিতির জন্ম হয়। সেই সমিতির উদ্যোগে প্রতিবছর ২০ রমজান হোসেনি দালান ও তার আশপাশের অনেক এলাকায় কাসিদা প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো,যেখানেই পুরান ঢাকার এবং পল্টন মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের কাসিদা লেখক ও তাদের দল অংশগ্রহণ করতো । কাসিদা প্রতিযোগিতায় এক একজন বিচারক কাসীদার এক একটি অংশের উপর লক্ষ রাখেন। মোট চারটি অংশ যেমন, ‘মিয়ারে কালাম’ অর্থাৎ কাসীদাটি ব্যাকরণসম্মত কিনা তা নির্ধারণ, ‘তালাফ্ফুস’ বা উর্দু উচ্চারণ সঠিক কিনা তা নির্ধারণ, ‘তারান্নুম’ বা সুর-তাল-লয় ঠিক আছে কিনা তা নির্ধারণ। এ ছাড়াও রয়েছে সময়ের সীমাবদ্ধতা। বারো মিনিটের মধ্যেই শেষ করতে হবে কাসীদা উপস্থাপন। সবাইকে পরতে হবে পাজামা-পাঞ্জাবি অথবা কাবলি স্যুট। জমা দিতে হবে উর্দুতে লিখিত কাসীদার কপি এবং পরিমাণে অতি অল্প (পঞ্চাশ বা এক’শ টাকা) এন্ট্রি ফি। কিন্তু পুরস্কারগুলি হয় খুব ভালো। যারা পুরস্কার পেত তারা ঈদের দিন বা ঈদের দ্বিতীয় দিনে আয়োজিত ঢাকার ঈদ মিছিলে অংশগ্রহণ করতো। বর্তমানে রমজানে পুরান ঢাকার লালবাগ,আজিমপুর,হাজারিবাগ,বখশী বাজার ইত্যাদি এলাকায় হামদর্দ,ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড,ঢাকাবাসী ইত্যাদি সংগঠন প্রতিষ্ঠান এর উদ্যোগে কাসিদার প্রতিযোগিতা ও আসর হয়। সেইসব কাসিদা প্রতিযোগিতা ও আসর গুলো রাত ১০ টার পরে শুরু হতো যা সাহরির আগ পর্যন্ত চলে। কোনো কোন কাসিদার প্রতিযোগিতা বা আসর শেষে যারা কাসিদা গায় তারা রাস্তায় রাস্তায় কাসিদা গেয়ে সাহরির ডাকাডাকি করেন। অনেকে মুড়ির টিন বা ড্রাম পিটিয়ে ডাকাডাকি করেন। বর্তমান যুগে মাইক,এলার্ম ঘড়ি,রেডিও,টিভি,মোবাইল এর মতো প্রযুক্তি আসার পরও কাসিদা টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চলছে। শায়লা পারভীন ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আনোয়ার কর্তৃক ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ক্বাসীদা নামে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে যেখানে অনেক কাসিদা লিপিবদ্ধ আছে। গত ২০২২ সালে রমজানে পুরান ঢাকার কাসিদা নিয়ে মাইটিভি নামক টিভি চ্যানেলে কাসিদা নামে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। তবে এই কাসিদার পাশাপাশি ঢাকার অনেক এলাকায় ও ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় সাহরির জন্য শেষ রাতে স্বাভাবিক ভাবে হামদ নাত গজল সহ ডাকাডাকি করতে দেখা যায়। অনেক মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,আসাম,দিল্লী,হায়দারা বাদ,উত্তরপ্রদেশ,বিহার,জম্মু ও কাশ্মীরে,পাকিস্তানের ইসলামাবাদ,সিন্ধ,করাচী,পাঞ্জাব, লাহোর,রাওয়ালপিন্ডি,খায়বার পাখতুনখোয়া,গিলগিট বালটিস্তান ও আযাদ কাশ্মীরে এই সাহরির ডাকাডাকি দেখা যায় যেখানে কেউ কেউ মাইকে বা রেকর্ডার স্পিকারে হামদ নাত কাওয়ালি বাজায়,কেউ ঢোল তবলা বাজিয়ে ডাকাডাকি করে । এদেরকে সাহার খান Sahar khan বলে।
Comments
Post a Comment