প্রসঙ্গ: ঐতিহাসিক গাদীরে খুমের ঘটনা
আহসান উদ্দিন
মহানবী মুহাম্মদ সাঃ এর দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আগে জীবনের শেষদিকের ঘটনাগুলো ইসলামের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মধ্যে বিদায় হজ্জ ও গাদীরে খুমের ঘটনা অন্যতম।অনেকেই হয়ত গাদীরে খুম বিষয়ে কিছুই জানে না। তাই এবিষয়ে সংক্ষেপে কিছু লিখলাম।
বিদায় হজ ছিল রসূলুল্লাহ (সা.) এর মদিনার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।বিদায় হজে রসূলুল্লাহ (সা.) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দেন যেগুলো ক্রমান্বয়ে ০৯ জিলহজ আরাফার ময়দানে,১০ জিলহজ মীনায় এবং ১৮ জিলহজ্ব বিদায় হজ শেষে মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে। প্রিয়নবি সা: ০৯ জিলহজ্জের খুতবায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও পরামর্শ দেন, বিশেষত কিতাবুল্লাহ(আল্লাহর কিতাব) আকড়ে ধরার নির্দেশ দেন।১০ জিলহজ্জের খুতবায় বহু জরুরি আহকাম শিক্ষা দেন(বুখারী ও সুনানে আবু দাউদ)। বিদায় হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা হতে মদীনার দিকে যাত্রা করেন এবং ১৮ জিলহজ এর দিন ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছেন ও সেখানে যাত্রাবিরতি করেন। এটি ছিল মক্কা হতে তিন মাইল দূরে ‘জোহফা’ নামক স্থান, যা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ‘গাদীর’ অর্থ পুকুর। এখানে পৌঁছার পর রসূলুল্লাহ (সা.) একটি খোৎবা প্রদান করেন। এটিকে বলা হয় ‘গাদীরে খুম’ এর খুৎবা।রসূলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ হতে হজরত আলী (রা.) বিশেষ উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন। ‘গাদীরে খুম’ এ যখন খোৎবা প্রদান করেন তখন হজরত আলী (রা.)ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই দিন নবীজি মুহাম্মদ সাঃ এর সাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বাইতের সদস্যরা সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। যোহরের নামাজের পরে রাসূলুল্লাহ সাঃ গাদীরে খুমের সেই খুৎবা প্রদান করেন। যাতে তিনি তার মৃত্যু সন্নিকটে হবার ইশারা করেন এবং কুরআন ও সুন্নাহকে আকড়ে ধরার তাকীদ করেন।
সেই সাথে আহলুলবাইতের সদস্যদের প্রতি ভালোবাসা মহব্বতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।হঠাৎ করে সেখানে রসূলুল্লাহ (সা.) আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) সম্পর্কে বললেন, “মান কুনতু মাওলাহু‘ ফা আলীয়্যুন মাওলাহু”। অর্থাৎ- “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।”
হজরত জাইদ ইবনে আরকাম(রা.) হতে ইমাম আহমদ (রহ.) বর্ণনা করেন, যখন রসূলুল্লাহ (সা.) গাদীরে খুমে পৌঁছেন, তখন আলী (রা.) এর হাত ধরে বলেন; “তোমরা কি জান না যে, আমি মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের সত্তা হতে উত্তম।” তারা সবাই বলল; “হ্যাঁ”। তিনি বললেন;
“তোমাদের কি জানা নেই যে, আমি প্রত্যেক মুমিনদের জন্য তাদের নিজের চেয়ে উত্তম।” সবাই বলল; “হ্যাঁ।” তখন তিনি বললেন; “হে আল্লাহ! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা/বন্ধু। হে আল্লাহ! যে আলী (রা.)-কে বন্ধু মনে করে, তুমিও তাকে বন্ধু মনে কর। আর যে আলী (রা.) এর সাথে দুশমনি করে, তুমিও তার সাথে দুশমনি কর।” অতঃপর হজরত উমর ফারুক (রা.) হজরত আলী (রা.) এর সাথে সাক্ষাত করে তাকে ধন্যবাদ জানান।
এই হাদিসটা সুনানে তিরমিজী,সুনানে ইবনে মাজাহের ১১৬ নম্বর হাদিস.মুসনাদে আহমাদের ১৮০১১ নম্বর হাদিস,নাসির উদ্দিন আলবানীর সিলসিলাতুল সহীহা এর ১৭৫০ নম্বর হাদিসে এবং ইবনে হাজার মক্কী এর ‘ছাওয়ায়িক মুহাররিকা" তে এসেছে। আল্লামা আব্দুর রউফ দানাপুরী সাহেব তার বিখ্যাত ‘আস সিয়ার’ গ্রন্থে এতদসংক্রান্ত হাদীসগুলোর কথা উল্লেখ করে নানা দিক বিশদভাবে আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন।
শিয়ারা উপরোক্ত হাদিসের আলোকে আলী রাঃ কে প্রথম খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করে,একই ধরনের কথা সদর উদ্দিন চিশতির " মাওলার অভিষেক ও ইসলামে মতভেদের কারণ " বইয়েও রয়েছে। কিন্তু গাদীরের উক্ত খুতবার কোথাও নবীজী সাঃ পর হযরত আলী রাঃ কে প্রথম খলীফা নিযুক্ত করতে হবে এমন কোন কথা নেই। উক্ত ভাষণের মাধ্যমে আহলে বাইতের প্রতি সকলের মোহাব্বতের সম্পর্ক রাখার তাকীদ করা হয়েছে। মূলত এই গাদীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইসলামের ইতিহাসে শিয়া, রাফেজী,ইসমাঈলী ও নাসেবী মতবাদের জন্ম হয়েছিল
১৮ জিলহজের গাদীরের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায় একে ঈদে গাদীর বা ঈদুল বেলায়াত হিসেবে এবং আমাদের এইদেশে সদর উদ্দিন চিশতি নামে এক পীর লেখক ও বাউল বয়াতীদের অনুসারীরা একে মাওলার অভিষেক দিবস হিসেবে পালন করে।একসময় আমি ছাত্রজীবনে বিশেষত ১২-১৭ বছর বয়সে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি ঈদুল আযহার ছুটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দেখতাম ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় দুইটা পোস্টার লাগানো আছে। দেখলাম সেই পোস্টারে লেখা "হাদিস: আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা, ১৮ই জিলহজ ঐতিহাসিক মাওলার অভিষেক দিবস সৌজন্যে : তরিকতে আহলে বাইত বাংলাদেশ" আরেকটায় লেখা "সৌজন্যে: সদর প্রকাশনী ও হেরাবন সংঘ "।পরবর্তীতে জানতে ও বুঝতে পারলাম এরা বাউল বয়াতী ও চুনকুটিয়ার বিতর্কিত পীর লেখক সদর উদ্দিন চিশতির অনুসারী,এরা এই ১৮ জিলহজ এর দিন উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকা এবং শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও ভাবসংগীত সম্মেলন অনুষ্ঠান এর আয়োজন করে । তখন ১২-১৫ বছর বয়সে অর্থাৎ ২০১৪-২০১৭ সালে আমার কাছে এই বিষয়টি অবাক লাগল,সে সময়ে মাওলার অভিষেক,গাদীরে খুম ও ঈদে গাদীর এই তিন শব্দ প্রথমবারের মত শুনেছিলাম।শিয়া সম্প্রদায় শাসিত/পরিচালিত রাষ্ট্র ইরানে এই ১৮ জিলহজকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেখানে শিয়ারা ধুমধামে এই দিন পালন করে ,সেখানে আনন্দ ফূর্তি করে,সেদেশের অধিকাংশ রেডিও ও টিভি চ্যানেলে দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালাও সম্প্রচার করে থাকে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইরাকে অবশ্য এটার কোনো সরকারি ছুটি নাই আমার জানামতে,তবে উইকিপিডিয়ার আলোকে সেখানে বাগদাদ,নাজাফ,কারবালা ও সামারায় শিয়ারা এই দিনে বিশেষ ইবাদত বন্দেগি করে ও আনন্দ উদযাপন করে। ইদানীং ইয়েমেনের অনেক জায়েদি শিয়ারাও বারো ইমামী শিয়াদের সাথে মিল রেখে প্রতিবছর এই কথিত ঈদে গাদীর দিবস উদযাপন করছে। বিশেষত ইয়েমেনের ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ সমর্থিত সশস্ত্র দল হুথি কট্টর শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও তাদের অনুসারী সুপ্রিম পলিটিকাল কাউন্সিল বা মাজলিসু সিয়াসিল আ'লা প্রতিবছর এই ঈদে গাদীর বা ঈদুল বেলায়াত উদযাপন করছে।জেনে রাখা উচিৎ এই হুথিরা পুরোপুরি জায়েদি নয় বরং তারা যায়েদিদের উপশাখা জারুদিয়া নামক সম্প্রদায় থেকে আগত। এই জারুদিয়া শিয়ারা রাফেযিয়া ও ১২ ইমামী সম্প্রদায়ের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে।
কিন্তু আমরা সুন্নিরা একে ঈদ হিসেবে উদযাপন করি না তবে এটাকে একটা ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে মনে করি। ১৮ জিলহজকে ঈদে গাদীর হিসেবে পালন না করার কারণ হচ্ছে এই দিনে আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ৩৫ হিজরীর ১৮ জিলহজ্জে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান রাঃ খারেজীদের হাতে শহীদ হন। যা ছিল একটা মর্মান্তিক ঘটনা। তাই একারণে ১৮ জিলহজকে ঈদ হিসেবে পালন করাকে বিদআত বলে মনে করেন অধিকাংশ সুন্নি মুসলিমরা। ইতিহাসের পাতার দিকে তাকালে আমরা দেখি যে আব্বাসীয় খলীফা মুতী‘ বিন মুক্বতাদির বা মুতিলিল্লাহ এর সময় তাঁর কট্টর শী‘আ আমীর মুইযযুদ্দৌলা ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ৩৫১ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখকে ঈদ হিসেবে ঘোষণা করেন
এই সংক্রান্ত সরকারি ফরমান জারি করেন এবং জোরেশোরে, ধুমধামের সাথে ঢোল বাজিয়ে আনন্দ উল্লাশের নির্দেশ দেন।পরের বছর ৩৫২ হিজরী সালের শুরুতে মোয়েজুদ্দৌলা যে, ১০ মোহাররম হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এর শোক মাতমে সকল দোকান পাট বন্ধ রাখা, বেচাকেনা বন্ধ করা , শহর ও গ্রাম অঞ্চলের সকল মুসলমানকে মাতমী পোশাক পরিহিত অবস্থায় ‘নূহা’ (আহজারী) করার নির্দেশ দেন। ফলে তখন ৩৫১ হিজরী থেকে এই দিনটি শী‘আদের মধ্যে ঈদুল আযহার চাইতেও গুরুত্ব পায়।
গাদীর নিয়ে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি হল:
➤নবীজীর নবুয়তের স্থলাভিষিক্ত আলী, আলী আলাইহিসসালামই একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু।
➤হযরত সিদ্দিকে আকবর আবু বকর রাঃ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে নাকি হযরত আলী রাঃ এর প্রতি অবিচার করেছেন।(আউজুবিল্লাহ)
➤আলী রাঃ সবার মওলা,নবির 'স্থলাভিষিক্ত, এটা জানার পরও হযরত উমর রাঃ নাকি আহলে বায়তের উপর অত্যাচার করেছেন।(আউজুবিল্লাহ ) ইত্যাদি।
শিয়ারা উপরোক্ত ভ্রান্ত মোটিভগুলোকে সামনে রেখে তারা গাদীর দিবসকে ঈদ হিসেবে পালন করে থাকে আহলে সুন্নাতের কোনো গ্রন্থ বা কোনো ফতোয়া দ্বারা 'ইয়াওমে গাদীর' কে 'ঈদে গাদীর' হিসেবে পালন করা সাব্যস্ত হয়না।'হাদীসে গাদীর' এর নাম দিয়ে বিভিন্ন ছবিযুক্ত পোস্টার বা চিত্রাংকন প্রচার করা এগুলো স্পষ্ট গোমরাহী।বিশেষত যা দেখা যায়, গাদীরে খুম এর প্রতিক হিসেবে দুইজন জুব্বা পরিহিত লোকের ছবি দেয়া হয়,যার একজন অন্যের ডান হাত উচু করে আছেন,সামনে অনেক মানুষ।যেনো একাবিংশ শতাব্দির সাথে তাল মিলিয়ে গাদীর উদযাপন।কিন্তু এটা করা জায়েজ নাই।
ইদানীং বাংলাদেশে প্রচুর শিয়াদের সমর্থক দালাল বেড়ে গিয়েছে।এরা ঘটা করে 'ঈদে গাদীর' পালন করছে।এরাই ১০ মুহাররাম এ আশুরা ইমামবাড়ায় গিয়ে পালন করে এবং মাতম ও তাজিয়া মিছিলকে জায়েজ মনে করে।
'ঈদে গাদীর' হলো শিয়াদের একটা ভ্রান্ত উদ্দেশ্যমূলক উৎসব।আপনি যদি সত্যিকারেই খুশি হয়ে থাকেন,তবে আপনাকে অবশ্যই এটাও মেনে নিতে হবে যে আপনি সত্যিকারের আলী রাঃ প্রেমিক,ঐ শিয়ারা নয়।আপনার 'ইয়াওমে গাদীর' নামে উদযাপনে হাক্বিকী/সত্যিকার প্রেম নিহিত থাকবে যেটা অভিশপ্ত শিয়া রাফেজীদের 'ঈদে গাদীর' এ পাওয়া যাবেনা। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহঃ বর্ণনা করেছেন , উম্মাহর মধ্যে যে কেউ যদি রাসূল সাঃ কর্তৃক অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়ে আউলিয়া রূপে অভিষিক্ত হন , তিনি হয় হযরত আলী রাঃ অথবা হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহঃ এর কাছে ঋণী ।
এই গাদীরে খুম বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে ইদ্রিস কান্ধলভী রহঃ এর সীরাতে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-৩/১৪৯-১৫১ পৃষ্ঠা,মাওলানা মুহাম্মদ নাফে সংকলিত ‘হাদীসে ছাকালাইন’,ডঃ তাহির উল কাদেরীর মানাকিবে আহলে বায়ত,এ'লানে গাদীর বা The Ghadeer Declaration(গাদীরে খুমের ভাষন) এই বইগুলো পড়ার অনুরোধ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন আমিন।
Comments
Post a Comment