প্রসঙ্গ : শিয়াদের ঈদ এগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান
ঈদ মানে আনন্দ খুশি। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে দিনটি বারবার ফিরে আসে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঈদ। আল্লাহ তা‘আলা এদিনে তার বান্দাকে নি‘আমাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করে থাকেন, বারবার ইহসান করেন। যে কারণে মুসলিম তথা ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা নিয়ামত ও শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ খুশি উদযাপন করে যাকে ঈদ বলে। ইসলামে প্রধানত দুইটা ঈদ পালন করে সব মুসলিমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা । ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী শেষ নবী রাসূল মুহাম্মদ সাঃ এর মদিনা হিজরতের পরে অন্যান্য বিধানের মতো ইসলাম ধর্মে এই দুই ঈদের বিধান শুরু হয়। ঈদুল ফিতর পালিত হয় হিজরী বা মুসলিম ক্যালেন্ডারে পবিত্র রমজান মাস শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে এবং ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ পালিত হয় হিজরী ক্যালেন্ডারের শেষ মাস যুল হিজ্জাহ/জিলহজ্ব মাসের ০৯ তারিখ আরাফার দিনের শেষে জিলহজের ১০ থেকে ১২ তারিখে । ঈদুল ফিতরের ১ম দিন (০১ শাওয়াল) এবং ঈদুল আযহার দিনগুলোতে (১০ থেকে ১৩ জিলহজ্ব) মোট ৫ দিন রোযা রাখা নিষিদ্ধ বা হারাম। এর পাশাপাশি হাদিস ও সুন্নাহর আলোকে জানা যায় যে শুক্রবার বা জুমার দিনকেও সাপ্তাহিক ঈদ বলা হয়েছে। রবিউল আউয়াল মাসে রাসূল মুহাম্মদ সাঃ এর জন্ম বা দুনিয়াতে শুভাগমনের দিন তথা মিলাদুন্নবী সাঃ বা মাওলিদ কেও ঈদে মিলাদুন্নবী সাঃ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
কিন্তু আমরা দেখি মুসলিম বিশ্বে অনেকগুলো সম্প্রদায় ফিরকা মতবাদের অনুসারী মুসলিম দেখা যায়। বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে প্রধানত সুন্নি বা আহলে সুন্নাহ এবং শিয়া বা আহলে তাশাইয়্যু এই দুই সম্প্রদায় দেখা যায়। সুন্নি বা আহলে সুন্নাহ এবং শিয়াদের ধর্মবিশ্বাস তথা আকীদা,আমল ভিন্ন ভিন্ন। সুন্নি বা আহলে সুন্নাহ অনুসারী মুসলিমদের চার ফিকহী মাযহাব তথা হানাফি শাফেয়ী মালিকী ও হাম্বলী,আহলে হাদিস সালাফি এবং আশআরী মাতুরিদী ও আছারী এ তিনটি আকীদাগত মতবাদ চিন্তাধারা দেখা যায়। শিয়া সম্প্রদায় ৬/৭ টি মতবাদে বিভক্ত। সেগুলো হলো ১২ ইমামীয় বা ইমামীয়া জাফরী,রাফেজী,ইসমাঈলী আগাখানী,আলাবী বা নুসাইরী,ইসমাঈলি বোহরা,যায়েদী এবং নুরবখশী। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পাশাপাশি ১৮ জিলহজ ঈদে গাদীর পালন করে। ইমামীয় শিয়ারা ১৮ জিলহজ ঈদে গাদীর,২৪ জিলহজ ঈদে মুবাহালা এবং ০৯ রবিউল আউয়াল ঈদে যাহরা পালন করে।
সুন্নিরা মহানবী মুহাম্মদ সাঃ এর পরে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আবু বকর সিদ্দীকে আকবর রাঃ, উমর ইবনে খাত্তাব রাঃ বা উমর ফারুকে আযম রাঃ, উসমান ইবনে আফফান রাঃ ও সাইয়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালিব রাঃ এই চারজন কে খলিফা বা ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ নেতা খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে মান্য করে তবে কেউ কেউ আলী রাঃ এর পরে হযরত হাসান ইবনে আলী রাঃ কে খলিফা মনে করে বিশ্বাস করে যে ইসলামের খলিফা বা খোলাফায়ে রাশেদীন ০৫ জন। কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের বা শিয়া মতবাদের অনুসারীরা এর থেকে পুরাই বিপরীত। শিয়ারা হযরত আলী রাঃ কে প্রথম খলিফা মনে করে। শিয়াদের অধিকাংশই হযরত আলী রাঃ কে খলিফা বিলা-ফছল অর্থাৎ বিরতি ছাড়া খলিফা বা মহানবী সাঃ এর পরে সরাসরি খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করে। ১২ ইমামীয় শিয়াদের আস্তে আস্তে উত্থান ঘটে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার ঘটনার পরে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে হযরত যাইনুল আবিদীন রাঃ এর মারা যাওয়ার পরে। হযরত যাইনুল আবিদীন রাঃ এর ১৫ জন সন্তান ছিলেন যার মধ্যে মুহাম্মদ আল বাকিরকে ইমামীয় ও ইসমাঈলী শিয়ারা ইমাম মনে করে এবং যায়েদ ইবনে আলী রাঃ কে যায়েদী শিয়ারা ইমাম মনে করে,৭১৪ খ্রিস্টাব্দে যায়েদ ইবনে আলী রাঃ ইমাম হওয়ার পরে জায়েদী শিয়াদের অভ্যুদয় হয় । ইমামীয়া জাফরী ও ইসমাঈলী শিয়ারা পর্যায়ক্রমে হযরত আলী রাঃ,হাসান রাঃ,হুসাইন রাঃ,যায়নুল আবিদীন রাঃ,মুহাম্মদ আল বাকির রাঃ এবং জাফর আস সাদিক রাঃ কে তাদের ইমাম বা খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করে। জাফর আস সাদিক রাঃ এর মৃত্যুর পরে ইসমাঈলিয়্যা শিয়াদের অভ্যুদয় হয়। ১২ ইমামীয়া শিয়ারা জাফর সাদিক রাঃ এর পরে পর্যায়ক্রমে মুসা কাযিম রাঃ,আলী আর রেযা রাঃ,তাকী আল জাওয়াদ,আলী আল হাদী নাকী,হাসান আল আসকারী এবং মুহাম্মদ আল মাহদীকে ইমাম বা খলিফা হিসেবে মনে করে এবং মুহাম্মদ আল মাহদীকে ১২তম ও শেষ খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করে। ইসমাঈলী শিয়ারা ইসমাঈল ইবনে জাফর ও তার ১২ ছেলেদেরকে ইমাম হিসেবে মনে করে,পরে ইসমাঈলিরা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় নিযারী এবং ফাতিমী বোহরা । নিযারী ইসমাঈলীরাই আগাখানী নামে পরিচিত। নিযারী বা আগাখানী ইসমাঈলীরা নাজ্জার বা নিযার এবং রুকুনুদ্দিন খুরশাহ সহ তার ০৯ ছেলেদেরকে এবং পর্যায়ক্রমে কাসিম শাহ ও তার ছেলে থেকে বর্তমানে শাহ করিম আগা খানকে তারা ইমাম হিসেবে মানে। আগাখানীদের বর্তমান ইমাম হলেন তাদের ৪৯ তম ইমাম। বোহরা শিয়ারা তাইয়েব বিন আমরকে তাদের ইমাম বা খলিফা মনে করে এবং তারা তাদের ২২ তম নেতা যোয়েব বিন মুসা (মৃত্যু ১১৫১ খ্রি:) থেকে শুরু করে বর্তমানে তাদের ৫৩ তম ইমাম সর্বোচ্চ নেতা মুফাদ্দাল সাইফুদ্দিন পর্যন্ত যারা তাদের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম ছিলেন তাদেরকে তারা দ্বাঈ আল মুতলাক বলে বিশ্বাস করেন।
হিজরী ১৮ জিলহজে ঈদে গাদীর এটা ১২ ইমামীয় বা ইমামীয়া জাফরী,রাফেজী,ইসমাঈলি আগাখানী ও বোহরা শিয়ারা এবং যায়েদীদের মধ্যে জারুদিয়া সম্প্রদায়ের অনেক লোকজন ও হুথি শিয়ারা পালন করে। এটা শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আনন্দের দিন এটাকে মাওলার অভিষেক বা ঈদে বেলায়াতও বলে অনেকে । মূলত ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ শেষে ১৮ জিলহজ মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী এক জায়গা জোহফায় গাদীরে খুম নামক স্থানে মহানবী মুহাম্মদ সাঃ ও সাহাবায়ে কিরামগণ বিশ্রাম নেন,সেখানে নবীজি সাঃ বলেন 'আমি যার মাওলা আলী রাঃ ও তার মাওলা "(সুনানে তিরমিজি)। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা মনে করে যে গাদীরের ঘটনায় নাকি হযরত আলী রাঃ কে প্রথম খলিফা ঘোষণা করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে তারা এই ঈদে গাদীর পালন করে। ইমামীয় শিয়ারা এর পাশাপাশি বাকী দুইটা ঈদ পালন করে একটা হিজরি জিলহজ মাসের ২৪ তারিখ ঈদে মুবাহিলা এবং আরেকটা হিজরী তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল এর ০৯ তারিখ ঈদে যাহরা বা ঈদে সুজা।
ঈদে মুবাহিলা মূলত ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় মুসলিমদের সাথে নাজরানের খ্রিস্টানদের ঐতিহাসিক মুবাহালার ঘটনা ও সেখানে আহলে বায়ত বা নবী পরিবারের সদস্য সহ মুসলিমদের বিজয় স্মরণে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ঈদ পালন করে। তারা এই ঈদে মুবাহালা ২৪ জিলহজ পালন করে।এগুলো তাদের নিকট আনন্দ খুশির দিন। ইমামীয় জাফরী/১২ ইমামীয়া এবং রাফেজী শিয়ারা মুহররম ও সফর মাসে কারবালার ঘটনায় হুসাইন রাঃ এর শাহাদাতের কারণে শোক পালন করে তারা এই দুই মাস কোন আনন্দ দিবস উৎসব পালন করে না। তবে অনেক যায়েদী বিশেষত ইয়েমেনের হুথি শিয়ারা মুহররমের শুধু প্রথম ১০-১২ দিন কারবালার ঘটনা স্মরণে এবং এ মাসের শেষদিকে ২৫-২৯ তারিখে ইমাম যায়েদ ইবনে আলী রাঃ এর স্মরণে শোক পালন করে,ইসমাঈলী ও যায়েদী শিয়ারা সফর মাসে কোনো শোক পালন করে না ।
হিজরি তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল এর ০৯ তারিখে ১২ ইমামী বা ইমামীয় জাফরী শিয়া এবং রাফেজী শিয়ারা ঈদে যাহরা/জাহরা বা ঈদে সুজা পালন করে । এটাকে আরবীতে ফারহাত আল যাহরা ও ফারসিতে ওমর কোশান বলে। মূলত মুহররম ও সফর মাসে ইমামীয় জাফরী শিয়া এবং রাফেজী শিয়াদের দীর্ঘ দুই মাস শোক পালন শেষে এবং ০৮ রবিউল আউয়াল শিয়াদের ১১ তম ইমাম হাসান আল আসকারির মৃত্যুর তারিখ শেষে এই ঈদে যাহরা আসে। ০৯ রবিউল আউয়াল এই ঈদে যাহরার দিন থেকে ইমামীয় শিয়াদের পূর্ণাঙ্গ আনন্দ উল্লাস শুরু হয়। মূলত ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ১০ মুহররম কারবালার ঘটনার ৫৮ বা ৫৯ দিন পরে ০৯ রবিউল আউয়াল কারবালায় নবী পরিবারের অনেক সদস্যদের উপর অত্যাচার চালানোয় অভিযুক্ত কুখ্যাত আমর বিন সা'দকে শাস্তিস্বরূপ মেরে ফেলা হয় এ ঘটনা শুনে হযরত যায়নুল আবিদীন রাঃ ও সাইয়্যিদা যাইনাব রাঃ খুশি হন এবং তাদের দুঃখ কষ্ট দূর হয় এবং ইমামীয় শিয়াদের মতে এই ৯ রবিউল আউয়ালে হাসান আসকারির ছেলে মুহাম্মদ আল মাহদি তিনি ইমাম মাহদী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। এই কারণে ০৯ রবিউল আউয়াল তারা ঈদে যাহরা বা ঈদে সুজা পালন করে। তবে এটা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। রাফেজী শিয়ারা ৯ রবিউল আউয়ালে উমর রাঃ এর হত্যাকারী আবু লুলুর প্রশংসা করে আনন্দ উচ্ছাস করে যা সুন্নি মুসলিমদের নিকট খুবই আপত্তিকর।
শিয়াদের এই তিন ঈদ পালন সুন্নি মুসলিমদের দৃষ্টিতে বিদআত ও বর্জনীয়।
Comments
Post a Comment